ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

বিদেশে যাচ্ছে চাটমোহরের কুমড়া বড়ি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩  

বিদেশে যাচ্ছে চাটমোহরের কুমড়া বড়ি

বিদেশে যাচ্ছে চাটমোহরের কুমড়া বড়ি

পাবনার চাটমোহর উপজেলার দু’ শতাধিক দরিদ্র পরিবার কুমড়া বড়ি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অর্ধশত বছরের এ ঐতিহ্য এখন গৃহস্থের বাড়ির আঙিনা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিকভাবেও উৎপাদিত হচ্ছে। আশ্বিন মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে কুমড়া বড়ি তৈরি। ডাল আর কুমড়ার মিশ্রণে তৈরি হয় অনন্য স্বাদের ‘কুমড়া-বড়ি’।হরেক রকম ডাল দিয়ে এ বড়ি তৈরি হলেও অ্যাংকর ও মাসকলাই-এর ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহসহ বিদেশেও যাচ্ছে চাটমোহরের কুমড়া বড়ি।  
 
চাটমোহর পৌর সদরে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার কুমড়া বড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এছাড়াও উপজেলার উপজেলার দোলং, বোথর, মথুরাপুর, বালুচর, রামনগরসহ বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে দু’ শতাধিক পরিবার কুমড়া বড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সাথে সরাসরি জড়িত। 

এই পরিবারগুলো শীত মৌসুমের পুরোটাই কুমড়া বড়ি উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বাড়ির মহিলারাই মূলত বড়ি তৈরি করে থাকেন। পুরুষরা বাজারজাত করে থাকেন। এতে তারা মৌসুমি উপার্জন করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন।  

চাটমোহর পৌর এলাকার দোলং গ্রামের কুমড়া বড়ি উৎপাদনকারী ঊষা রানী ভৌমিক জানান, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এই পেশায় আছি। একটা সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের। আগে সারাদিন ডাল ভিজিয়ে রেখে শিল-পাটা দিয়ে বেটে বড়ি দিতে হতো। এতে করে সময় লাগত অনেক বেশি। এখন শিল-পাটায় বাটার বদলে ডাল মেশিন দিয়ে ভাঙানো হয়। এতে করে আমাদের খাটনি কমেছে ও সময় বেঁচে যাচ্ছে। এতে এখন বেশি বড়ি তৈরি করতে পারছি।’ 

দোলং গ্রামের সুদীপ দাস, মায়ারাণীসহ অন্যান্যরা জানান, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সাধারণত ডাল ভিজিয়ে মেশিনে গুঁড়ো করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে বড় গামলা বা বালতিতে ডালের গুঁড়ো, পাকা চালকুমড়া, কালোজিরা, গোল মরিচ, এবং আরও কিছু মশলা মিশিয়ে সুস্বাদু কুমড়া বড়ি তৈরি করা হয়।  এরপর টিনের বা কাঠের পিঁড়িতে সরিষার তেল মাখিয়ে কাপড়ের সাহায্যে জিলেপি তৈরির মতো বড়ি করে সাজিয়ে শুকাতে দেওয়া হয়। ৩-৪ দিন কড়া রোদে শুকালে প্রস্তুত হয় সুস্বাদু কুমড়া-বড়ি। এ কাজগুলো নারীরাই করে থাকেন। 

কুমড়ো বড়ি বিক্রেতা সুনীল সরকার ও প্রদীপ ভৌমিক জানান, ‘আকারভেদে প্রতিটি বুড়ো চাল কুমড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনতে হয়। এছাড়াও ৮৫-৯০ টাকা কেজি খেসারি, অ্যাংকর ডাল ৪০ এবং ১২০ টাকা কেজি দরে মাসকলাই ডাল কিনে কুমড়া বড়ি তৈরি করে থাকি। প্রতি কেজি ডাল থেকে সাড়ে ৭শ’ থেকে ৮শ’ গ্রাম বড়ি তৈরি হয়। বাজারে ডালভেদে ১০০-১৫০ টাকা কেজি দরে কুমড়া বড়ি বিক্রি করে থাকি। তবে অ্যাংকর ও মাসকলাই-এর ডালের বড়ির চাহিদা একটু বেশি থাকে। আর খুচরা বাজারে ডাল বড়ি এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়।’ 

তারা আরো বলেন, চাটমোহরের উৎপাদিত কুমড়া বড়ি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে জেলা শহর হয়ে এখন রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের কাঁচা বাজারগুলোতে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন পাইকাররা চাটমোহরে আসেন কুমড়া বড়ি কিনতে। তবে পাইকারি দাম কিছুটা কম নেয়া হয়। এছাড়া অর্ডার দিয়ে বানালে খরচটা আরো বেশি পড়ে। শিল-পাটায় বাটা ডালের বড়ির কদর সবসময় একটু বেশি থাকে।

এদিকে আত্মীয়-স্বজনদের হাতঘুরে কুমড়া বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালিদের রসনা তৃপ্ত করছে। এ অঞ্চলের মানুষ যারা আমেরিকা, কানাডা, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইটালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচিতি পাচ্ছে এ সুস্বাদু তরকারি। 

কুমড়া বড়ি উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন গড়ে প্রতিদিন ২০ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করে দিতে পারেন। বাড়ির দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে নারীদের পক্ষে এটা করা সম্ভব হয়। কারণ  ভোর থেকে শুরু করে সকাল ৯টার মধ্যে বড়ি তৈরি বা রোদে দেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত কুমড়া বড়ির ভালো ব্যবসা চলে। এ মৌসুিম ব্যবসা করে  সংসারে বাড়তি আয় করে বহু পরিবার দারিদ্র দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। যেমনটি পৌর সদরের শাহী সমজিদ এলাকা ও দোলং গ্রামের গ্রামের চাপারানী, উত্তম মহ, হাবুল, শাহজাহান, স্বপ্না, মালতী মায়ারানী, সীমা সহ শতাধিক পরিবার এই কুমড়ো বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। 

স্থানীয়রা জানান, বড়ি তৈরিতে চাল কুমড়ার সঙ্গে ডালের যেমন নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রান্নার সময় কুমড়া বড়ির সঙ্গে মিঠাপানির মাছ থাকলে তা অনন্য হয়ে ওঠে। এই কুমড়ো বড়ি যে কোনো ঝোলের মাছের তরকারি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চলনবিলের দেশি প্রজাতির কৈ, মাগুর, শিং, শৈল, আইড়, গজারসহ মাছের তরকারি রান্নায় স্বাদে বৈচিত্র আনতে ব্যবহার করা হয় এই কুমড়া বড়ি। অনেকে নিরামিষ তৈরিতে ডাল মেশান। 

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন জানান চলনবিল এলাকায় কুমড়া ও ডালের যেমন প্রাচুর্য রয়েছে তেমনি এখানে আছে বড়ি তৈরি দক্ষ কারিগর। ফলে এ কুটির শিল্পটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। 

পাবনা বিসিক এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) রফিকুল ইসলাম জানান, পাবনার চাটমোহরের কুমড়া বড়ি শিল্প একটি সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প। এ শিল্পে চাটমোহরের কয়েকশ’ মানুষ বাড়তি আয় করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। এ শিল্পে খুব একটা পুঁজি লাগে না। তাই ঋণের জন্য কেউ আসেন না। তবে কেউ এজন্য সহযোগিতা চাইলে তাদের জন্য দরজা খোলা রয়েছে। 

 

আরও পড়ুন
সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়