ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ আঞ্চলিক ভাষা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:২০, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ আঞ্চলিক ভাষা

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ১০ আঞ্চলিক ভাষা

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলারই আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। অঞ্চল ভেদে মানুষের কথ্য ভাষা ভিন্ন। তবে কিছু জেলাতে আঞ্চলিক ভাষার নিজস্ব রূপ, বিস্তৃত শব্দভান্ডার এতটাই পৃথক যে—তা বাংলা ভাষা থেকে ভিন্ন মনে হয়। যেমন—রংপুরের কেউ চট্টগ্রামে গেলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ বিপাকে পড়ে। তবে এই ভাষা ছাড়াই যেন চট্টগ্রামের মানুষের চলে না। প্রতিটি জেলার মানুষের কাছেই নিজের মায়ের মুখের ভাষা বেশ গর্বের।

বাংলাদেশের কিছু জনপ্রিয় আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে এই আয়োজন—

ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা

পুরান ঢাকার কুট্টি সম্প্রদায়ের বাঙালিরাই ‘কুট্টি উপভাষায়’ কথা বলেন। বিপুল পরিমাণ আরবি ও ফারসি শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ এই উপভাষা। প্রমিত ভাষার সঙ্গে ঢাকাইয়া কুট্টির পার্থক্যও রয়েছে; যেমন— যাচ্ছি > যাইতাছি, করবো>করুম। মুঘল আমলে ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কুট্টি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে বাংলা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণে ১৭৬০ সালের দিকে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার জন্ম হয়।

চট্টগ্রামের চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষা

চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার মানুষের প্রধান ভাষা চাটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গা ভাষা। এটি ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর একটি সদস্য ভাষা। ভাষাবিদদের মতে, চাটগাঁইয়া ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিবেচিত। তবে বাংলা ভাষার সাথে এর শব্দগত মিল থাকায় একে বাংলার উপভাষা মনে করা হয়।

বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলেন। বিশ্বের কথ্য ভাষার তালিকায় এর অবস্থান ৮৮ তম।  আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে বাংলার পরে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। প্রমিত ভাষার সঙ্গে চাটগাঁইয়া ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—সকাল > বেইন্না, মোরগ > রাতা কুরা।

সিলেটের সিলেটি আঞ্চলিক ভাষা

আঞ্চলিক ভাষার দিক থেকে সিলেটি ভাষা অনেক প্রাচীন। ধারণা করা হয়, সিলেট শহরের নামানুসারে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা সিলেটের স্থানীয় ভাষাকে সিলেটিয়া নামে অভিহিত করেন। এই ভাষাটি সিলেটের সুরমা উপত্যকা অঞ্চলে, ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং হোজাই জেলায় প্রচলিত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। সিলেটি ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও রয়েছে। যার লিপিতে ৩৩টি বর্ণ রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটসহ বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ মানুষ সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। এত ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে এটি বিশ্বের ৯৭ তম বৃহৎ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রমিত ভাষার সঙ্গে সিলেটি ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—সমস্ত > হক্কল, জামাই > দামান।

নোয়াখালীর নোয়াখাইল্লা আঞ্চলিক ভাষা

বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষাকে নোয়াখালীয়/ নোয়াখাইল্লা ভাষা বলা হয়। বিভিন্ন জেলার আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে এটি অনেক বেশি আকর্ষণীয়, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং নাট্যাভিনয়ে অন্যতম উপযোগী ভাষা। এটি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্গত উপভাষীয় বাংলার একটি অংশ। নোয়াখালী অঞ্চল ছাড়াও চট্টগ্রাম, ভোলা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার কিছু অঞ্চলের মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এটি প্রায় ৭০ লাখ মানুষের কথ্য ভাষা। প্রমিত ভাষার সঙ্গে নোয়াখাইল্লা ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—পানি > হানি, শুয়ে পড়ো > হুতি যা।

ময়মনসিংহের মোমেনশিঙ্গা আঞ্চলিক ভাষা

বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান উপভাষাকে ময়মনসিংহীয় উপভাষা বা মোমেনশিঙ্গা বাংলা ভাষা বলা হয়। এটি বাংলা ভাষার বাঙালি উপভাষার একটি বৃহৎ অংশ। ময়মনসিংহ বিভাগসহ দেশের ঢাকা বিভাগ, সিলেট বিভাগ, ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের অনেকটা অংশজুড়ে এই ভাষার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। প্রমিত ভাষার সঙ্গে নোয়াখাইল্লা ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—টাকা > ট্যাহা/ টেহা, খাবো > খাইবাম।

বরিশাল জেলার বরিশাইল্যা আঞ্চলিক ভাষা

বরিশালের ভাষাটি পর্যায়ক্রমিকভাবে বাংলা অসমিয়া থেকে বাংলা উপভাষার একটি অংশ হিসেবে এসেছে। ধারণা করা হয়, ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাকলাসহ পার্শ্ববর্তী মাদারীপুর ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে তৎকালীন চন্দ্র রাজবংশের রাজারা ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ছিল বরিশাইল্যা ভাষা। বর্তমানে প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ এই উপভাষা ব্যবহার করেন। প্রমিত ভাষার সঙ্গে বরিশাইল্যা ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—হাঁটু > আঁডু, শেওলা > হিদলা।

খুলনা জেলার খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষা

খুলনার খুলনাইয়া আঞ্চলিক ভাষা অনেকাংশে বাংলা প্রমিত ভাষার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। খুলনা জেলার পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা পূর্বে ভারতের নদীয়া উপজেলার অন্তর্গত ছিল। তখন থেকেই কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকার অধিবাসীদের কথ্য ভাষায় ভারতীয় নদীয়া জেলার ভাষার প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে খুলনাইয়া ভাষার অবদান ব্যাপক। চারণ কবিতা, সংগীত, গদ্য রচনা, নাট্য অভিনয় ইত্যাদি বহু সাংস্কৃতিক পটভূমিতে খুলনার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে যুগে যুগে। প্রমিত ভাষার সঙ্গে খুলনাইয়া ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—লবণ > নেমক, জঙ্গল > বাদা।

রাজশাহী জেলার বরেন্দ্রী উপভাষা

প্রাচীন বরেন্দ্র ভূমির অন্যতম একটি অঞ্চল রাজশাহী। তাই রাজশাহী বিভাগে বসবাসকারীরা স্থানীয়ভাবে যে ভাষায় কথা বলেন তাকে বরেন্দ্রী উপভাষা বলা হয়। এই ভাষার নিজস্ব দু’টি উপভাষা রয়েছে। সেগুলো পূর্বী উপদল ও পশ্চিমি উপদল নামে পরিচিত। বরেন্দ্রী উপভাষায় লিখিত রূপ হিসেবে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহৃত হয়। প্রমিত ভাষার সঙ্গে খুলনাইয়া ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—আমি > হামি, আসছে > আইচ্চে।

রংপুর জেলার রংপুরী আঞ্চলিক ভাষা

বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা রংপুরী ভাষা নামে পরিচিত। প্রাচীন ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কামপুরী ভাষার একটি অংশ রংপুরী/ রাজবংশী ভাষা। রংপুরের এই আঞ্চলিক  বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১.৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এটি। প্রমিত ভাষার সঙ্গে খুলনাইয়া ভাষার বেশ পার্থক্য রয়েছে; যেমন—মেয়ে > চেংড়ি, পুরুষ > ব্যাটাছাওয়া।

কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা

প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করি তা অনেকাংশেই কুষ্টিয়া জেলার কথ্য ভাষার অনুরূপ। এই জেলার ভাষা অত্যন্ত স্পষ্ট, শ্রুতিমধুর, উচ্চারণে জড়তাহীন ও সকলের কাছে সহজবোধ্য। বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ এই ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা,  লালনগীতি, সংগীত, পালাগান, জারিগান, মেলা, বাউল গান, পাঁচালি, যাত্রা, কৃষকের মেঠো গান ইত্যাদি রচিত হয়েছে। এটি শুদ্ধ বাংলা ভাষা হওয়ায় কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়