ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শেরপুর জেলায় এখনও পাওয়া যায় সেই ব্রিটিশ আমলের মহিষের দুধের টক দই

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২৮ মার্চ ২০২৪  

শেরপুর জেলায় এখনও পাওয়া যায় সেই ব্রিটিশ আমলের মহিষের দুধের টক দই

শেরপুর জেলায় এখনও পাওয়া যায় সেই ব্রিটিশ আমলের মহিষের দুধের টক দই

সেই ব্রিটিশ শাসন আমল থেকেই শেরপুরের ঝগড়ার চর এলাকায় ঐতিহ্যবাহী মহিষের দুধের টক দই বেশ সুনাম অর্জন করে আসছে। এ টক দই শুধু শেরপুরই নয়, শেরপুরের আশপাশের জেলাসহ ঢাকা পর্যন্ত এর ঐতিহ্য ও কদর রয়েছে। তবে আগের মতো ওই টক দইয়ের হাটের জৌলুস না থাকলেও এখনো সপ্তাহে দুই দিন মহিষের দুধের টক দই বিক্রির হাট বসে। সে হাটে জেলা শহর থেকে শুরু করে জেলার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে টক দই কিনতে আসে টক দইপ্রেমী মানুষ। তৎকালীন স্থানীয় জমিদার শেরপুরের ওই ঝগড়ার চর গ্রাম থেকে মহিষের দুধের টক দইসহ বিভিন্ন মিষ্টান্ন নিয়মিত অর্ডার করে নিতেন।

ব্রিটিশ গেছে, জমিদার গেছে, পাকিস্তান অমলও গেছে, তারপরও এখনো সেই আগের স্বাদ ও ঐতিহ্য নিয়ে মহিষের দুধের টক দই বিক্রি হচ্ছে শেরপুরের ওই ঝগড়ারচর বাজারে।

সারা জমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার ভেলুয়া ইউনিয়নের ঝগড়ারচর গ্রাম। শেরপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বের ওই ঝগড়াচর গ্রামে এখনো বসে মহিষের দুধের টক দইয়ের হাট। ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি প্রথা শুরু হলে ওই গ্রামের কিছু মানুষ গরু-ছাগলের পাশাপাশি মহিষ পালন করেন। আর ওই মহিষের দুধ এবং দুধ দিয়ে তৈরি টক দই বিক্রি করতেন ঝগড়া চর বাজারে। সে সময় আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে মিষ্টির পাশাপাশি এক হাড়ি টক দই ও কিছু গুড় নিয়ে যেতেন। শেরপুর অঞ্চলে ১৮’শ শতকের শেষের দিকে জমিদারি প্রথা শুরু হলে তৎকালীন শেরপুরের নয়নী জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী ওই গ্রামের গোয়ালদের কাছ থেকে মহিষের দুধ ও টক দইসহ বিভিন্ন মিষ্টি অর্ডার দিয়ে কিনে নিতেন। জমিদার বাড়িতে দই বিক্রি করতেন এমন পরিবারের সদস্যদের সূত্রে জানা গেছে, ওই এলাকার যেসব গোয়াল জমিদার বাড়িতে মিষ্টি ও টক দই দিতেন তাদের প্রতি খুশি হয়ে ঝগড়ার চর এলাকায় বেশ কিছু জমি পত্তন দিয়েছিলেন তৎকালীন জমিদার।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদারি প্রথা উঠে গেলে জমিদাররা ভারতে চলে যায়। ফলে শেরপুরের ওই ঝগড়াচর এলাকার গোয়ালদের টক দই তৈরি ও বিক্রি কিছুটা ভাটা পড়ে। এরপরও বংশ পরম্পরায় কেউ কেউ এবং এ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় নতুন করে অনেকেই টক দইয়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানে ওই ঝগড়ার চর বাজারে স্থানীয় একটি হাইস্কুল মাঠে প্রতি শনি ও বুধবার বসে টক দইয়ের হাট। তাদের সেই মহিষের দুধের টক দই এর গুণগতমান আগের মত থাকায় এখনো মানুষ শহর এবং আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে টক দই কিনতে ভিড় করেন ওই হাটে।

শেরপুর শহর থেকে টক দই কিনতে আসা প্রভাষক রেজাউল করিম জানায়, দীর্ঘদিন থেকেই এই টক দই খাই আমরা। রোজা শুরু হয়েছে তাই টক দই দিয়ে শরবত তৈরি করে ইফতার করি। এ টক দই আমাদের খুবই উপকারী ও প্রয়োজনীয় বলে এখানে কিনতে আসছি।

চর হাবর গ্রামের টক দই বিক্রেতারা আলাল জানায়, খুব সাবধানতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এ টক দই তৈরি করা হয়। মাটির হাড়ি পরিষ্কার করে তাতে দুধ রেখে দই তৈরি করে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে রেখে দেন তারা। এরপর ওই দই হাটে নিয়ে বিক্রি করা হয়। ঝগড়ার চর ও আশপাশের ৫ থেকে ৬টি গ্রামের মানুষ মহিষের টক দই বিক্রির উদ্দেশ্যেই একাধিক মহিষ পালন করে। তারা প্রতিদিন মহিষের দুধ সংগ্রহ করে ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর হাটের আগের দিন দই তৈরি করেন। প্রতিটা মহিষ থেকে ৬ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত দুধ সংগ্রহ করা যায়। সেই দুধ থেকে দই তৈরি করে ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এতে যে লাভ হয় তাতে তাদের সংসার বেশ ভালই চলে। তবে বর্তমানে রোজার কারণে টক দইয়ের কদর ও চাহিদা বেড়েছে। তাই প্রতি কেজি দই ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ঝগড়া চর বাজারে টক দই বিক্রেতা হাবিবুর রহমান জানায়, ব্রিটিশ আমল থেকে এই হাটে মহিষের টক দই বিক্রি হয়ে আসছে। এ টক দই শরীরের জন্য অনেক উপকারী তাই রোজা ছাড়াও বছর জুড়ে চাহিদা রয়েছে এ দইয়ের।

এদিকে এই টক এর উপকারিতা নিয়ে জামালপুরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাদিম হাসান জানান, টক দইয়ের রয়েছে নানা গুণাগুণ ও উপকারিতা। বিশেষ করে টক দই এর প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট থাকে যা মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া দুধ এর চেয়ে টক দইয়ের গুণাগুণ অনেকটাই বেশি। তাই আমরা টক দই খেতে সাজেস্ট করি।

কোনোরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এখনো শত শত বছর ধরে শেরপুরে মহিষের দুধের টক দইয়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তারা। যদি সরকারি সহযোগিতা পায় তবে এ ঐতিহ্য আরও শত শত বছর টিকে থাকবে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছেন।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়