ঢাকা, রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

‘তাল বেগুন’ চাষে কৃষকের মুখে হাসি

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

‘তাল বেগুন’ চাষে কৃষকের মুখে হাসি

‘তাল বেগুন’ চাষে কৃষকের মুখে হাসি

নাটোর সদর উপজেলার শেষ প্রান্তের গ্রাম বালিয়াডাঙ্গা। এই গ্রামের শতভাগ মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত। পূর্ব পুরুষদের হাত ধরে আসা চিরাচরিত নিয়মে চলা কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন করে এই গ্রামের কৃষকরা আধুনিক কৃষির সংস্পর্শে এসেছেন কিছুটা দেরিতে। তবে তাদের নতুন কিছু করার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা সাফল্য এনে দিয়েছে।

এক সময় গ্রামের সব কৃষকই ধান, পাট, গম চাষ করলেও বর্তমানে গ্রামটির অন্তত ৪০ জন কৃষক আধুনিক পদ্ধতিতে ‘তাল বেগুন’ চাষ করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। 

জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে ১৫০ মণ ‘তাল বেগুন’ উৎপাদন হয় এই এলাকায়। এই বেগুনকে কেন্দ্র করে গ্রামটিতে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আড়ত। যেখানে সকাল থেকেই গ্রামের বিভিন্ন ক্ষেত থেকে বেগুন নিয়ে আসেন কৃষকরা। উৎপাদিত এই বেগুন কিনতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে আসেন ব্যাপারীরা। এ গ্রামের দেখাদেখি আশপাশের‌ অন্তত দশটি গ্রামে তাল বেগুনের চাষ শুরু হয়েছে। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আড়তগুলোতে তাল বেগুনের একেকটি স্তূপ। সেখানে একদিকে কৃষকদের নিয়ে আসা বেগুন পরিমাপ, বাছাই ও বস্তাজাতকরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন আড়তের শ্রমিকরা।‌ আবার তাল বেগুনের ক্ষেতে গেলে দেখা যায় একদিকে বেগুন হারভেস্ট করা অন্যদিকে গাছ পরিচর্যা ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যস্ত রয়েছেন বেগুন চাষিরা।

গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার কৃষক নবীর হোসেন বলেন, তিন ছেলে ও এক মেয়েসহ ৬ সদস্যর সংসার আমার। বাড়ির পাশের ছোট একটু জমিতে চাষাবাদ আর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো‌। বছর দুয়েক আগে পরিচিত একজনের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল তাল বেগুনের কথা জানতে পারি। তারপর প্রথমে ১০ কাটা জমিতে শুরু করি এর চাষ। সেই জমিতে ভালো ফলন পেয়ে অটোরিকশা বিক্রি করে মনোযোগ দিয়ে তাল বেগুন চাষে নেমে পড়ি। তার পরের বছর জমি বর্গা নিয়ে দুই বিঘায় এই বেগুন চাষ করি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় এখন গ্রামে তাল বেগুন চাষে সফল চাষী হিসাবে পরিচিত হয়েছি। 

তিনি আরও বলেন, বেগুন চাষের আয়ের টাকা থেকেই কয়েক মাস আগে বড় ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছি। দুই ছেলে ও ছোট মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি। সর্বোপরি এখন পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে। আমার দেখাদেখি অনেকে নতুনভাবে তাল বেগুনের চাষ শুরু করেছেন। বিভিন্ন সময় তারা আমার কাছে পরামর্শ নিতে আসলে তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

বেগুনের আড়তে কথা হয় কৃষক আমানুল্লাহ সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করেছি। সপ্তাহে দুই-তিন দিন বেগুন তুলি। আজকে আড়তে ৫ মণ বেগুন নিয়ে এসেছি। প্রতি মণ ১৮০০ টাকা দরে বিক্রি করে বিল হয়েছে ৯ হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, এই দামে বেগুন বিক্রি করে আমরা বেশ লাভবান হচ্ছি। তবে যদি বেগুনে ব্যবহৃত কীটনাশকের দাম একটু কম হতো তাহলে আরও বেশি লাভ করতে পারতাম।

আরেক বেগুন চাষি লালন হোসেন বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে এটার বিপণন ব্যবস্থাটা ভালো। তাই অন্যদের দেখে উৎসাহিত হয়ে প্রথমে ১ বিঘা ও বর্তমানে ২ বিঘা জমিতে তাল বেগুনের চাষ করছি। অন্য সব ফসলের চেয়ে তাল বেগুনে কয়েক গুণ বেশি পরিচর্যা করতে হয়। প্রতিদিন ক্ষেতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। তবে এত কষ্ট হলেও সারাবছর এর দাম থাকায় এবং গ্রাম থেকেই ব্যাপারীরা নিয়ে যাওয়ায় ভালো লাভ করতে পারেন তারা‌। 

তিনি আরও বলেন, আমি দুই বিঘা জমিতে তাল বেগুন চাষ করেছি। যেখানে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার বেগুন বিক্রি করেছি। ক্ষেতে এখনো অনেক বেগুন আছে সেগুলো ধীরে ধীরে বিক্রি করবো।

রাজশাহী থেকে আড়তে তাল বেগুন কিনতে আসা ব্যাপারী হাসান আলী বলেন, নাটোরের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রচুর তাল বেগুনের চাষ হয়। এখানকার বেগুন মানের দিক থেকেও উন্নত। যার কারণে ঢাকাতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা বেগুন কিনতে আসার আগের দিন ফোনে কৃষককে বেগুনের রেট জানিয়ে দেই। পরদিন এসে ওজন করে ভালোভাবে বস্তাজাত করে ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন আড়তে পাঠাই।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে সদর উপজেলায় তাল বেগুনের চাষ হয়েছে ১৬ হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদিত তাল বেগুনের পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টন।

নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার নীলিমা জাহান বলেন, তাল বেগুনসহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের বেগুন চাষ হচ্ছে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। এতে কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছেন। 

তিনি বলেন, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা উপজেলার প্রতিটি এলাকায় কৃষকের সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা সবার দৌড়গড়ায় পৌঁছাতে না পারলেও প্রতিটি ইউনিয়নে পরামর্শ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে গিয়েও কৃষকদের পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এমন জমিতে এই জাতের বেগুন চাষ করা যায়। বর্ষাকালে সবজির অনেক ঘাটতি থাকে, ফলে এই সময় তাল বেগুন সবজির এই ঘাটতি অনেকটাই লাঘব করে। প্রতিটি তাল বেগুনের ওজন ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। নাটোরের স্থানীয় বাজারে এই বেগুনের চাহিদা কম থাকলেও ঢাকায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফলে কৃষকরা সারা বছরই ভালো দাম পান। 

তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পাশে রয়েছে। তাল বেগুন চাষিদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে পরামর্শ ও সহযোগিতা করার জন্য নিকটস্থ কৃষি কর্মকর্তাদের তাগিদ দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন
সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়