ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কান্না আর গৌরবের স্মারক

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:৫২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২  

কান্না আর গৌরবের স্মারক

কান্না আর গৌরবের স্মারক

সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ। এর পশ্চিমের একটি দেয়ালে রঙ-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের একাধিক চিত্র। আর পূর্ব পাশের মুক্তমঞ্চের কোণে রয়েছে শ্যাওলা পড়া, মরিচা ধরা, ভাঙাচোরা দুটি বিধ্বস্ত গাড়ি। গাড়ি দুইটি বহন করছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি।

এসব গাড়িতে করে রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বহু মুক্তিযোদ্ধা, দেশ প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-জনতা, নারী পুরুষকে ধরে আনা হতো। জোহা হল ক্যান্টনমেন্টে তাদের নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হতো। মুক্তমঞ্চের ঠিক পেছনে রয়েছে একটি ভবন। সেখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের এক বিশাল সংগ্রহশালা। স্বাধীনতা যুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারীদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘরটি। এটি শহিদ স্মৃতি সংগ্রহশালা নামে পরিচিত।

এই সংগ্রহশালায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশের প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রামের সব তথ্য যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসের নানা সংগ্রহে ভরপুর সংগ্রহশালাটি। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার জন্য একটি পাঠাগার।

জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগ্রহশালাটি। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শিক্ষকদের পত্নী বেগম ওয়াহিদা রাহমান, বেগম মাস্তুরা খানম ও শ্রীমতী চম্পা সমাদ্দার ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী গ্যালারি উদ্বোধন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিতে সাজানো সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র এবং কর্মচারীদের স্মৃতিচিহ্ন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র, শহিদদের প্রতিকৃতি, কোলাজ, ভাস্কর্য ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি। ৬ হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের সংগ্রহশালাটিতে আছে মোট তিনটি গ্যালারি। আলাদা গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সরঞ্জাম ও বিভিন্ন আলোকচিত্র।

একতলা বিশিষ্ট সংগ্রহশালার প্রবেশ করতেই বারান্দায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আলোকচিত্র। আরো রয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, জাতীয় চার নেতার অন্যতম এ এইচ এম কামারুজ্জামান, গণঅভ্যুত্থানে শহিদ প্রক্টর শামসুজ্জোহা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীকদের তালিকা সংবলিত ছবি। এরপর সংগ্রহশালার প্রথম গ্যালারির ফটক।

প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে ৫৯টি আলোকচিত্র, ৬টি প্রতিকৃতি, ২টি কোলাজ, ৮টি শিল্পকর্ম, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৭টি, ভাস্কর্য ১টি, ডায়েরি ও অন্যান্য পাণ্ডুলিপি ৪টি এবং বাঁধাইকৃত ২টি আলোকচিত্র রয়েছে। এ গ্যালারিটিকে সাজানো হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের নানা স্মারক দিয়ে।

এই গ্যালারিতে আরো রয়েছে- ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহীতে (রাজশাহী কলেজ হোস্টেল গেটে) নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারের বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, আমতলার সভা, কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল; ১৯৫২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি, নগ্নপদ মিছিল; ’৫৩-র শহিদ মিনার; ’৬৯-র গণবিক্ষোভের মুখে পুলিশ বাহিনী; ’৬৯-র বিক্ষুব্ধ জনতা ও ব্যারিকেড; শহিদ আসাদ, শহিদ মতিউর, শহিদ রফিক, শহিদ বরকত, শহিদ সালাম ও শহিদ শামসুজ্জোহার প্রতিকৃতি; ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলের অগ্রভাগে শামসুজ্জোহা; ৬৯-এ রাবি শিক্ষকদের মিছিল, গুলিবিদ্ধ-হাসপাতালে মৃত-কফিনে শায়িত ড. জোহার ছবি। এছাড়া প্রখ্যাত শিল্পী মোস্তফা মনওয়ারের শিল্পকর্ম, সুজা হায়দারের বর্ণমালা, আবু তাহেরের অসহায় আত্মা, উত্তম দের কোলাজ মুক্তিযোদ্ধার শার্ট, প্রণব দাসের ভাস্কর্য ‘আর্তনাদ’।

প্রথম গ্যালারি থেকে বের হয়ে বামে দ্বিতীয় গ্যালারি। এই গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, ৯টি শিল্পকর্ম, ১৯টি বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, ৩টি ভাস্কর্য, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৯৯টি এবং ৫টি ডায়েরি। এ গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নানা সংগ্রহ ও স্মারক দিয়ে।

এছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় ৪ নেতা এবং রাবির শহিদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি; বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ; স্বাধীনতার ঘোষণা-বাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ঢাকার রাজপথ, ’৭১-র গণবিক্ষোভ, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ’৭১-র ছাত্রী নিগ্রহ, ধর্ষিত মাতা-জায়া, গণহত্যা, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজপথ, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র; মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার; শিল্পীদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য; শহিদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি; রাবি এবং রাজশাহীর শহিদদের আলোকচিত্র।

দ্বিতীয় গ্যালারি থেকে বের হতেই বারান্দায় চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নারী বীরপ্রতীক সেতারা বেগম, তারামন বিবি, কাঁকন বিবি, বিদেশি নাগরিক বীরপ্রতীক উইলিয়াম এএস ওডারল্যান্ড, ইন্ধিরা গান্ধীসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল আকৃতির বাঁধাই করা ছবি। রয়েছে বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা ডাকটিকিট। এরপর বারান্দা হতে হতে একটু ভেতরে রয়েছে আরো একটি কক্ষ। তার সামনে রয়েছে বঙ্গবন্ধু এক নিরাপত্তা রক্ষীকে খাওয়ার জন্য হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এমন একটি ছবি, রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের সমরেখা সংবলিত একটি জীবনবৃত্তান্ত যথা তার বাল্য, কৈশোর, রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়ের বর্ণনা।

কক্ষে ভেতরে রয়েছে গবেষকদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষণা পাঠাগার ও বঙ্গবন্ধু কর্নার। এখানে আছে ১৯৪৭ থেকে ’৭১-এর ওপর প্রায় সাড়ে চার হাজার বই, পুস্তিকা, ইশতেহার ও সঙ্কলন। বইয়ের পাশাপাশি এখানে আছে ১৯৪৭ থেকে ’৭১ সালের বাঁধাইকৃত বিভিন্ন পত্রিকা। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টের কাটিংসহ নানা নিদর্শন সংরক্ষণ করা রয়েছে। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত নয় শতাধিক গ্রন্থ, ছবিসহ নানা স্মারক। এসব দেখে বা বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট বই পড়ে মহান এ নেতার বর্ণাঢ্য জীবন, পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব, সুবিশাল রাজনৈতিক ইতিহাস খুব সহজেই জানা যাবে।

বঙ্গবন্ধু কর্নার থেকে বের হয়ে তৃতীয় গ্যালারি। এখানে আছে ১১২টি আলোকচিত্র, ১টি প্রতিকৃতি, ১১টি শিল্পকর্ম, ১টি বাঁধাইকৃত আলোকচিত্র, ৬টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরি-পাণ্ডুলিপি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৫৬টি। তিন নম্বর গ্যালারির মূল আকর্ষণ বঙ্গবন্ধুর নানান আলোকচিত্র। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও ব্যক্তিজীবনের নানা মুহূর্তের ছবি রয়েছে এ গ্যালারিতে।

এখানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ, রণাঙ্গনে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, বিজয়ী মুক্তিসেনা, হানাদারমুক্ত ঢাকা শহর, গণকবর, বুদ্ধিজীবী হত্যা, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র (মাইন, বুলেট, রকেট লাঞ্চার ইত্যাদি); শহিদ বুদ্ধিজীবী ও শহিদ সাংবাদিকদের ছবিসহ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি আলাদা বোর্ড; রাবির গণকবর থেকে প্রাপ্ত নাম না জানা অসংখ্য শহিদদের মাথার খুলি-হাড় ও তাদের ব্যবহৃত জিনিস। এছাড়া শিল্পী কামরুল হাসানের মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার এবং শিল্পী আমিনুল ইসলামের শ্বেতপত্র-৭১, চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধ।

শহিদ স্মৃতি সংগ্রহশালার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য মুক্তিযুদ্ধ-অনুপ্রাণিত তৈলচিত্র, ছাপচিত্র ও জলরঙ ছবির সংগ্রহ। বাংলাদেশের প্রধান চিত্রশিল্পীবৃন্দ যাদের কাজ এই সংগ্রহে স্থান পেয়েছে তাদের মধ্যে আছেন আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, রফিকুননবী, হাশেম খান, রশীদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী।

বন্ধুদের সঙ্গে সংগ্রহশালায় ঘুরতে এসেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বিজয়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অনেক অচেনা-অজানা মুখ রয়েছে যাদের সম্পর্কে কখনো জানা হয়নি তাদের সম্পর্কে জানতে পারলাম। আমার এই বয়সে যতটুকু পড়েছি সে অনুযায়ী এখানে আসার পর মনে হচ্ছে এখনো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করে স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন, তার প্রমাণ এই সংগ্রহশালা।

সংগ্রহশালাটির কিউরেটর ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জাদুঘর ও সংগ্রহশালা হলো শহিদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। বর্তমানে এখানে গোটা বাংলাদেশের শহিদদের সাড়ে ৭-৮ শত নিদর্শন রয়েছে। তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জামা-কাপড়, স্মৃতিচিহ্ন, ছবি, ফটোগ্রাফস, একাত্তরের বর্বরোচিত হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের বহু ফটোগ্রাফস রয়েছে।

সংগ্রহশালাটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সাপ্তাহিক ছুটি (শুক্র, শনি) ও সাধারণ ছুটির দিনগুলো বাদে অন্যান্য দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রতিদিন গড়ে দেশ ও দেশের বাইরের মিলিয়ে ২০০-৩০০ দর্শনার্থী সংগ্রহশালাটিতে ভিড় জমায়। তবে জাতীয় দিবসগুলো সমাগম আরো বেশি হয়।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়