ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে নতুন প্রকল্পে ঘুচবে অন্ধকার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৩৬, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩  

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে নতুন প্রকল্পে ঘুচবে অন্ধকার

রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে নতুন প্রকল্পে ঘুচবে অন্ধকার

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। তার জীবনকর্ম নিয়ে গবেষণায় চালু থাকা স্মৃতিকেন্দ্রটিতে নেই ন্যূনতম উপকরণ। কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে রোকেয়ার দেহাবশেষ আনার উদ্যোগটিও লাল ফিতায় বন্দী। ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি কেবলই আনুষ্ঠানিকতা আর নানা আশ্বাসে কেটে যায়।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উপমহাদেশের নারীসমাজকে কুসংস্কারের দেয়াল ছেদ করেছিলেন। গৃহবন্দী নারীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন আলোর মশাল। সেই মহীয়সী নারীর স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও পড়ে আছে অবহেলায়। উদ্যোগের অভাবে এখানে রোকেয়াচর্চা ও পর্যটন কেন্দ্রের দ্বারও রুদ্ধ। রোকেয়াবাসী জানে না তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার আলো ফুটবে কবে।

নারীমুক্তির আলোর দিশারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভিটায় ১৯৯৭ সালে স্থাপিত হয় একটি স্মৃতিকেন্দ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাবে স্মৃতিকেন্দ্রটির অবস্থা এখন শোচনীয়। ২২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় গড়ে তোলা বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি। আইনি জটিলতা কাটলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে এটি পড়ে আছে অবহেলায়।

অথচ নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তার গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতিচর্চা এবং স্থানীয় যুবাদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ২০০১ সালে স্মৃতিকেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। এ নিয়ে পায়রাবন্দবাসীর মনে ক্ষোভ জমে আছে। ৩ একর ১৫ শতক জমির ওপর নির্মিত কেন্দ্রটি দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে আসবাবসহ বিভিন্ন উপকরণ।

স্মৃতিকেন্দ্রটিতে একটি আধুনিক মিলনায়তন, সেমিনার কক্ষ, পাঠাগার, সেলাই মেশিনসহ একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। আরও আছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিস, কেন্দ্র চত্বরে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও উপপরিচালকসহ কর্মচারীদের আবাসনব্যবস্থা। জনবল-সংকটে বিভিন্ন কারণে সেলাই মেশিন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি বন্ধ। কাজে আসছে না মিলনায়তন। পাঠাগার থাকলেও নেই রোকেয়ার জীবনদর্শন জানানোর মতো পর্যাপ্ত বইপুস্তক।

১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০১ সালে তিনি এটি উদ্বোধন করেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথমে কেন্দ্রটির দায়িত্বভার নিলেও তিন বছর পর দায়িত্ব পায় এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা একাডেমি। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বাংলা একাডেমির অধীনে স্মৃতিকেন্দ্রটি হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়। তারপর বাংলা একাডেমির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সাড়ে তিন কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত এই কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু না হওয়াতে এতদিন হতাশায় ছিলেন রোকেয়াবাসী। অবশেষে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি নতুন করে গড়ে তুলতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পাল্টে যাবে স্মৃতিকেন্দ্রের চেহারা। স্মৃতিকেন্দ্রটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে বাংলা একাডেমি।

একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। থাকবে আন্তর্জাতিক গবেষণাকেন্দ্র। এ গবেষণাকেন্দ্রে মূলত নারীরাই প্রাধান্য পাবে। এছাড়া থাকবে সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, হেলথ সেন্টার, মুক্তমঞ্চসহ বেশকিছু অবকাঠামো। পাশাপাশি ধাত্রী, হস্তশিল্পসহ বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে তোলা হবে। এসব বাস্তবায়নে ৮৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিকেন্দ্রটিকে একটি অফিস ভবন, গেস্ট হাউস, মিলনায়তন, ডরমিটরি, গবেষণাকক্ষ, প্রশিক্ষণকেন্দ্র, গ্রন্থাগার নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিকেন্দ্রের পুকুরপাড়ে তৈরি করা হয় বেগম রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য। বর্তমানে গ্রন্থাগার থাকলেও সেখানে যুগোপযোগী বই ও সাময়িকী নেই। মিলনায়তনের অবস্থাও ভালো না। মঞ্চ ভেঙে গেছে অনেক আগেই, অধিকাংশ চেয়ারই ভগ্ন। নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকলেও বেশিরভাগ মেশিন নষ্ট। সংগ্রহশালায়ও নেই উল্লেখযোগ্য কোনো কিছু।

স্থানীয়রা ছাড়াও দীর্ঘদিন বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি সংস্কার ও উন্নয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও সংস্কৃতিকর্মীরা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্মৃতিকেন্দ্রটি নতুন প্রকল্প ঘিরে অন্ধকার ঘুচবে স্মৃতিকেন্দ্রটিতে, ফিরবে নতুন আলো এমনটাই স্বপ্ন দেখাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

বাংলা একাডেমিকর মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক কেএম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের সবুজ পাতায় তালিকাভুক্ত হয়েছে। ২০২৩ থেকে ২০২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর স্মৃতিকেন্দ্রের নকশা প্রণয়ন করবে।

রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্মৃতিকেন্দ্রটি বিকেএমই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়। এরপর দখলমুক্ত করে রোকেয়া চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার দাবি থাকলেও বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি। বাংলা একাডেমি নতুন করে এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য প্রাঙ্গণটি গবেষণা, রোকেয়াচর্চা, সর্বোপরি নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় হবে।

তিনি আরও বলেন, বেগম রোকেয়াকে নিয়ে দেশে কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ রোকেয়ার নামে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রোকেয়ার দর্শন ও চেতনাকে মনের মধ্যে লালন করা হচ্ছে না। স্মৃতিকেন্দ্রের পাঠাগারে রোকেয়া সম্পর্কিত দুটো বইপুস্তকও নেই। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও কিন্তু রোকেয়া আবশ্যিক নয়। সেখানে রোকেয়াকে নিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা হয় না। যার নামে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্মৃতিস্মরণে ভাস্কর্যও নেই। রোকেয়ার বাস্তভিটাকে প্রত্নসম্পদে পরিণত করতে কোনো উদ্যোগ নেই।

উল্লেখ্য, আজ ৯ ডিসেম্বর। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ১৪৩তম জন্মদিন ও ৯১তম মৃত্যুবার্ষিকী। নারী জাগরণের এই পথিকৃৎ ১৮৮০ সালের আজকের এই দিনে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম নেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর দিনটিতেই মৃত্যুবরণ করেন। এদিনটি বেগম রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাওয়া এ মহীয়সী নারীকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে জাতি।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মুসলিম সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কোন প্রচলন ছিল না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পরিবারের সবার অগোচরে তার বড় ভাইয়ের কাছে উর্দু, বাংলা, আরবি ও ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন। তার জীবনে শিক্ষালাভ ও মূল্যবোধ গঠনে তার ভাই ও বড় বোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিহারের ভাগলপুরে সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়। স্বামীর উৎসাহে ও নিজের আগ্রহে তিনি লেখাপড়ার প্রসার ঘটান।

বেগম রোকেয়া ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে ষষ্ঠতম নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে পরিচিত। তার উল্লেখযোগ্য রচনা হলো ‘মতিচূর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধ-বাসিনী’। ১৯৭৪ সাল থেকে পায়রাবন্দবাসী বেগম রোকেয়ার স্মরণে রোকেয়া দিবস পালন করে আসছেন। সরকারিভাবে ১৯৯৪ সাল থেকে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় বেশ ঘটা করেই দিবসটি পালন করা হয়।

দিবসটি পালনে রংপুরে নানা কর্মসূচি

বেগম রোকেয়া দিবসে রংপুরে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। তার জন্মস্থান মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। থাকছে তিন দিনের রোকেয়া মেলা। আজ সকালে বেগম রোকেয়ার স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটিতে স্থাপিত ফলকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্যদিয়ে দিবসের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন
সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়