ঢাকা, শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

রমজানে মনীষীদের ইবাদতের নমুনা ও সাধনা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:০৪, ২৩ মার্চ ২০২৪  

রমজানে মনীষীদের ইবাদতের নমুনা ও সাধনা

রমজানে মনীষীদের ইবাদতের নমুনা ও সাধনা

সর্বযুগের মনীষীরা রমজানকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে গ্রহণ এবং রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ করেছেন। তাদের চেষ্টা ছিল রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত, দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে ‘ফলবতী’ করে তোলা। কোরআন ও হাদিসে যেসব আমলের তাগিদ বেশি এসেছে, সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আমল করার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন।

রমজানে মনীষীদের দানশীলতা:

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) সর্বাপেক্ষা বেশি দানশীল ছিলেন। তার দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত রমজানের পবিত্র দিনে যখন জিবরাইল (আ.) তার সঙ্গে দেখা করতেন। জিবরাইল (আ.) রমজানের প্রতি রাতে তার সঙ্গে দেখা করে কোরআনের সবক দিতেন। নবী (সা.) কল্যাণ বণ্টনে প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল ছিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৫৫৪)

সুতরাং মুসলিম মনীষীরাও রমজানে বেশি বেশি দান করতেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘মুমিনের জন্য প্রিয় কাজ হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণে রমজানে দানের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। কেননা তা প্রয়োজন পূরণকারী একটি কল্যাণকামিতা এবং এতে মানুষের জীবন-জীবিকার বোঝা হালকা হয়, ফলে তারা নামাজ-রোজায় মনোযোগী হতে পারে।’ (মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদিস : ২৭৪৫)

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রোজা রাখতে মিসকিনদের সঙ্গে না নিয়ে ইফতার করতেন না। যদি তার পরিবার মিসকিনদের বাধা দিত, তবে সে রাতে তিনি ঘুমাতে পারতেন না। তিনি খাওয়ার সময় যদি কোনো ভিক্ষুক আসত, তিনি তার অংশের খাবার নিয়ে উঠে যেতেন এবং ভিক্ষুককে দিয়ে দিতেন। ফিরে এসে দেখতেন পরিবারের অন্যরা অবশিষ্ট খাবার শেষ করে ফেলেছেন। ফলে অভুক্ত অবস্থায় রোজা রাখতেন।’ (রুহানিয়্যাতু সায়িম, পৃষ্ঠা ১৭)

হাম্মাদ ইবনে আবি সোলায়মান (রহ.) রমজানে প্রতিদিন পাঁচ শ’ মানুষকে ইফতার করাতেন এবং ঈদের পর তাদের প্রত্যেককে এক শ দিরহাম করে দান করতেন। (সিয়ারু আলামুন-নুবালা : ৫/২৩৪)

রমজানে মনীষীদের অধিক কোরআন চর্চা:

রমজান কোরআন নাজিলের মাস। আল্লাহ এই মাসে কোরআনসহ অন্যান্য আসমানি গ্রন্থ নাজিল করেছেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সত্পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানে কোরআন চর্চায় আরো বেশি মনোযোগী হতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ফাতেমা (রা.)-কে বলেন, ‘জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর এসে পূর্ণ কোরআন একবার আমার কাছে পেশ করতেন। কিন্তু এ বছর তিনি এসে তা আমার কাছে দুবার পেশ করেছেন। এতে আমি ধারণা করছি, আমার চিরবিদায়ের সময় সন্নিকটে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৮৫)

এ জন্য পুণ্যাত্মা মনীষীগণ রমজানে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতেন। ইমাম মালিক (রহ.) রমজানে হাদিস ও জ্ঞানীদের মজলিস পরিহার এবং কোরআন তিলাওয়াতকে অগ্রাধিকার দিতেন। উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুুল মালিক প্রতি তিন দিনে একবার কোরআন খতম করতেন এবং রমজানে ১৭ বার কোরআন খতম করতেন।

কাতাদা (রহ.) রমজানে কোরআনের দরস দিতেন। তিনি প্রতি সাত দিনে একবার কোরআন খতম করতেন। রমজানের প্রথম দুই দশকে প্রতি তিন দিনে একবার এবং শেষ দশকে প্রতিদিন একবার কোরআন খতম করতেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) প্রতি মাসে ৩০ বার এবং রমজানে ৬০ বার কোরআন খতম করতেন। ইমাম বুখারি (রহ.) রমজানের দিনে একবার কোরআন খতম করতেন এবং রাতে তারাবির পর তাহাজ্জুদে এক খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। (সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ৮/৬৯, ৪/৩৪৭, ৫/২৭৩ ও ২৭৬, ১০/৩৬, ১২/৪৩৯)

রমজানে মনীষীদের তাহাজ্জুদ:

আল্লাহর কাছে তাহাজ্জুদ নফল নামাজের ভেতর সবচেয়ে প্রিয় আমল। পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে এই নামাজের প্রতি মুমিনদের উৎসাহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ৬৪)। মহানবী (সা.) নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। রমজানেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পবিত্র কোরআনে তাঁর তাহাজ্জুদ আদায় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়ুন। এটা আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব। অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭৯)

রমজানে মনীষীরা তাহাজ্জুদে মনোযোগী হতেন। আবু উসমান নাহদি (রহ.) বলেন, ‘আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর বাড়িতে সাতবার আতিথ্য গ্রহণ করেছি। তিনি, তার স্ত্রী ও তাদের সেবক রাতকে তিন ভাগে ভাগ করে নিতেন। একজন নামাজ পড়ে আরেকজনকে ডেকে দিতেন।’ (তাবাকাতুল হুফফাজ : ১/৪৫)

সাদ্দাদ ইবনে আউস (রহ.) যখন বিছানায় যেতেন মনে হতো উত্তপ্ত কড়াইয়ের ওপর একটি শস্যদানা। অতঃপর ‘হে আল্লাহ, জাহান্নাম আমাকে ঘুমাতে দেয় না’ বলে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। (তারিখে দামেস্ক : ২২/৪১৬)। সায়িব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) রমজানে তাহাজ্জুদের ইমামতির জন্য উবাই বিন কাব ও তামিমে দারি (রা.)-কে নির্দেশ দেন। তারা প্রতি রাকাতে দুই শ আয়াতের মতো তিলাওয়াত করতেন। নামাজ দীর্ঘ হওয়ায় আমরা লাঠির ওপর ভর দিতাম এবং ফজরের কিছু সময় আগে ঘরে ফিরতাম। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৪৮০০)

রমজানে কথা-কাজে মনীষীদের সংযম:

রমজান সংযম ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুমিন তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং পাপ কাজ পরিহারের অনুশীলন করে। এটা রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, ‘রোজা নিছক খাদ্য ও পানীয় পরিহারের নাম নয়। বরং তা মিথ্যা, বিভ্রান্তি, অর্থহীন কাজ ও (মিথ্যা) কসম পরিহারের নাম।’ (কানজুল উম্মাল, হাদিস : ২৪৩৮৯)

তালক ইবনে কায়েস (রহ.) থেকে বর্ণিত, আবু জর গিফারি (রা.) বলতেন, যখন তুমি রোজা রাখো, তখন যথাসম্ভব নিজেকে পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখো। তাল্ক (রহ.) রমজানে শুধু নামাজ পড়তে ঘর থেকে বের হতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৭০) মুজাহিদ (রহ.) বলতেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি মন্দ স্বভাব পরিহার করল, সে তার রোজাকে রক্ষা করল। পরনিন্দা ও মিথ্যা।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৮৯৮০)

রমজানে মনীষীদের পানাহার:

রমজানে মুসলিম মনীষীরা অল্প পানাহার করতেন। কেননা অধিক পানাহার মানুষের শরীরে আলস্য তৈরি করে এবং আল্লাহর ইবাদতে মনোযোগী হতে বাধা দেয়। আড়ম্বরপূর্ণ খাবার রমজানের উদ্দেশ্য পরিপন্থি। মুহাম্মদ ইবনে আমর আলগুজি (রহ.) রমজানে মাত্র দুই লোকমা খাবার গ্রহণ করতেন। (সিয়ারু আলামুন-নুবালা : ১১/৪৬৪)

আবুল আব্বাস হাশিম ইবনে কাসিম (রহ.) বলেন, আমি রমজানে মুহতাদির (রহ.)-এর কাছে ছিলাম। তিনি খাবার দিতে বললে একটি রুটি ও একটি পাত্রে সামান্য লবণ, তেল ও সিরকা হাজির করা হলো। তিনি আমাকে খেতে ডাকলেন। আমি খেলাম এবং আরো খাবারের অপেক্ষা করছিলাম। তিনি বললেন, তুমি রোজা ছিলে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি পুরোটা খেয়ে শেষ করো। কেননা তুমি যা দেখছ, তা ছাড়া আর কোনো খাবার নেই। (সিয়ারু আলামুন-নুবালা : ১২/৫৩৬)

বিংশ শতাব্দীর মনীষীদের রমজান:

আমাদের সর্বজনীন মুরুব্বি সুপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব হজরত শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) তারাবিতে সোয়া পারা শোনাতেন, সাহরি পর্যন্ত তরজমাসহ তা পড়তেন চার-পাঁচ বার। সে অংশটুকু তাহাজ্জুদের সময় শোনাতেন দুবার। সাহারি খাওয়ার পর ফজরের নামাজের আগে এবং পরে ঘুমানোর আগে সে অংশটুকু একবার তিলাওয়াত করতেন। সকাল দশটার দিকে ঘুম থেকে উঠে শীতের দিনে চাশতের নামাজে একবার এবং গরমের দিনে দুবার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের পনেরো মিনিট আগে দেখে দেখে দুবার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের ফরজের আগে সুন্নতে দুবার, পরের সুন্নতে একবার তিলাওয়াত করতেন। জোহরের নামাজের পর বন্ধুদের কাউকে একবার শোনাতেন। আসরের নামাজের আগে দু বা একবার পড়তেন। আসরের পর বয়স্ক কাউকে একবার শোনাতেন। মাগরিবের নামাজের পর নফল নামাজে সেই শোয়া পারা আরেক বার তিলাওয়াত করতেন। প্রতিদিনের আমল ছিল এভাবে। ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ত্রিশ বারে ত্রিশ পারা তিলাওয়াতে জোর দিতেন। [শায়খ জাকারিয়া (রহ.) এ আত্মজীবনী হতে সংগৃহীত]

কুতুবুল আলম মুজাদ্দিদে মিল্লাত হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী (রহ.) বাদ মাগরিব আওয়াবিনে দু পারা ও তাহাজ্জুদসহ দৈনিক অর্ধ খতম কোরআন তিলাওয়াত করতেন। হজরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) বাদ মাগরিব নফলে শোয়া পারা তিলাওয়াত করতেন। আর তাহাজ্জুদে করতেন সাধারণত দু’পারা তিলাওয়াত। তারাবিতে আমৃত্যু তিনি এই আমল করতেন।

আল্লামা কাসিম নানুতুবী (রহ.) ১২৭৭ হিজরিতে মক্কা-মদিনা সফরকালে রমজান মাসে কোরআন মুখস্থ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি বেশি বেশি তিলাওয়াত করতেন। একবার তিনি এক রাকাতে সাতাশ পারা তিলাওয়াত করেছিলেন। হাজী এমদাদুল্লাহ মক্কি (রহ.) সারা রাত বিভিন্ন হাফেজদের থেকে পালাক্রমে নামাজে তিলাওয়াত শুনতেন।

শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.) হাফেজ ডেকে নামাজে সারারাত কোরআন শরিফ শুনতেন। তারাবিতে কখনও ছয় পারা, কখনও দশ পারা পড়া হতো। হজরত শাহ আবদুর রহিম রায়পুরী (রহ.) হাফেজে কুরআন ছিলেন। প্রায় সারারাত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। চব্বিশ ঘণ্টায় তিনি শুধু এক ঘণ্টা ঘুমাতেন। শায়খুল ইসলাম হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) বাদ আসর দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আবদুল জলিল (রহ.)-এর সঙ্গে শোয়া পারা দাওর করতেন অর্থাৎ পরস্পর শোনাতেন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়