ঢাকা, সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

খাবারও দিচ্ছে, বোমাও মারছে যুক্তরাষ্ট্র

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ১০ মার্চ ২০২৪  

খাবারও দিচ্ছে, বোমাও মারছে যুক্তরাষ্ট্র

খাবারও দিচ্ছে, বোমাও মারছে যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে আকাশ থেকে একইসঙ্গে আমেরিকার বোমা এবং খাদ্য সহায়তার প্যাকেট ফেলেছে। একদিকে হত্যার জন্য শক্তিশালী বোমা সরবরাহ, অন্যদিকে জীবন বাঁচাতে খাদ্য সহায়তা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে ফের ভারসাম্য খুঁজে পেতে মরিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

গাজায় অতি প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে উড়োজাহাজ থেকে বাইডেনের খাদ্য সহায়তা এবং সেই লক্ষ্যে একটি অস্থায়ী ভাসমান বন্দর নির্মাণ তার নীতির ভারসাম্যহীনতাকেই তুলে ধরেছে। কারণ, তিনি গাজার শাসকগোষ্ঠী সশস্ত্র হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছেন।

ইসরায়েলকে অস্ত্র আর গাজায় ত্রাণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা

ইসরায়েলি বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং সেই অস্ত্রে আহত ফিলিস্তিনিদের সেবা দেয়ার চেষ্টাও করে বাইডেন প্রশাসন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য আরো কিছু করার জন্য বাইডেনের অনুরোধকে অস্বীকার করেছেন। এতে বাইডেন ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং গত সপ্তাহে তার স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ও এর পরেও সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি যুদ্ধের প্রভাব কমিয়ে আনতে অস্ত্র সরবরাহ কমানোর বিরোধিতা করছেন।

আমেরিকার নেতৃত্বে নতুন করে চালু করা আকাশ ও সমুদ্রে মানবিক সহায়তার প্রচারণা শুরু হয় স্থলপথে গাজায় পর্যাপ্ত সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর। এখন পর্যন্ত আমেরিকার কর্মকর্তারা এই ধরনের পদ্ধতিকে বাস্তবসম্মত নয় বলে মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নিলেও তা স্থলপথের মতো একই মাত্রায় সহায়তা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে না এবং বিভিন্ন উপায়ে জটিলতা তৈরি করবে।

বিমান থেকে খাদ্য সহায়তা যে আসলেই বিপজ্জনক, তা সর্বশেষ শুক্রবার স্পষ্ট হয়ে গেছে। সাহায্য প্যাকেজ পড়ে অন্তত পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। স্থলভাগে স্থিতিশীল বিতরণ ব্যবস্থা ছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম বিশৃঙ্খলা ও বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।

এদিকে বাইডেন প্রশাসনের সমালোচনা করে ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট কংগ্রেসম্যান রো খান্না বাইডেনের বক্তৃতার পরদিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আপনি একই সময়ে খাদ্য এবং খাদ্য ট্রাকগুলোতে বোমা ফেলার জন্য ইসরায়েলকে সহায়তা এবং অস্ত্র দেয়ার নীতি কার্যকর করতে পারেন না। এর মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বৈতনীতি রয়েছে।’

গত মাসে গাজায় ত্রাণ নেয়ার সময় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গুলি চালালে ১১২ জন নিহত হন। সমালোচকরা বলেছেন, এ ধরনের সরবরাহ ব্যবস্থা খুব সামান্যই প্রয়োজন পূরণ করে এবং তা যুদ্ধের ব্যাপারে বাইডেনের পদ্ধতির নৈতিক দ্বন্দ্বকেই তুলে ধরে।

ওয়াশিংটনের আরব সেন্টারের প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল প্রোগ্রামের প্রধান ইউসুফ মুনায়ার বলেন, এটার কোনো মানে হয় না। এটি অগ্নিসংযোগকারীকে জ্বালানি দেয়ার সময় এক কাপ পানির সঙ্গে পাঁচ-অ্যালার্ম আগুন দেখানোর মতো। প্রশাসন একটি রাজনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। ভোটারদের ক্ষোভ প্রশমিত করার লক্ষ্যে এই কৃত্রিম ব্যবস্থার মাধ্যমে ভয়ংকর যুদ্ধকে সমর্থন করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এক হাতে অস্ত্র দিচ্ছে, অন্যদিকে সেই অস্ত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেয়ার অপচেষ্টা করছে- গণপরিসরে উত্থাপিত এমন সমালোচনার জবাব দিতে রাজি হননি বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

ইসরায়েলকে কখন থেকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিয়ে আসছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি কে ট্রুম্যান ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে এই রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন। তিনি কেন প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে এত দ্রুত তড়িঘড়ি করে স্বীকৃতি দিলেন? এটি ছিল বিরাট এক প্রশ্ন। কিছুটা হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। ট্রুম্যানের সাবেক ব্যবসায়ী অংশীদার এডওয়ার্ড জ্যাকবসন ইসরায়েল রাষ্ট্রের মার্কিন স্বীকৃতি আদায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরে কৌশলগত বিষয়ও যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত নিতে আগ্রহী করে তুলেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তখন কী এমন কৌশলগত বিষয় ছিল? আসলে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই। তখন যুক্তরাষ্ট্র আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হচ্ছিল।

মধ্যপ্রাচ্য তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল। রয়েছে সুয়েজ খালের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এটাই বিশ্বশক্তিগুলোকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নামতে উৎসাহী করে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা ছিল, তারা আগেই তুলনামূলক দুর্বল হয়ে পড়া ইউরোপীয় শক্তিকে নিজের পক্ষে টেনে আনতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এত কিছুর পরও তখনো ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ছিল না।

কখন থেকে একচেটিয়া সমর্থন দেওয়া শুরু

এই রহস্য অনেকটা নিহিত ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে দুর্বল মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই যুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের বাকি ঐতিহাসিক জায়গা দখল করে নেয়। এর বাইরে সিরিয়া ও মিসরের কিছু অঞ্চল দখল করে। তখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। তারা এই রাষ্ট্রটির প্রতি আরব বিশ্বের কোনো ধরনের মনোভাবকে তোয়াক্কা করে না।

এত গেল একটা দিক। প্রশ্ন হচ্ছে, আর কী এমন কোনো বিষয় রয়েছে, যার কারণে ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? এই প্রসঙ্গে বলতে হয় ১৯৭৩ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের কথা। সেই যুদ্ধে আবারও মিসর ও সিরিয়াকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ইসরায়েলি বাহিনী। এই যুদ্ধে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রেরও কিছু ভূমিকা ছিল। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে মিসরকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে চেয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় সেটা ব্যাহত হয়। যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। তার সেই প্রচেষ্টা ১৯৭৯ সালে কিছুটা আলোর মুখ দেখে।

ইসরায়েলপন্থী রাজনীতির প্রভাব কতটা

যুক্তরাষ্ট্রে এমন অনেক সংগঠন রয়েছে, যারা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন তৈরিতে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)।

এই সংগঠনের সদস্যদের প্রভাব মার্কিন ইহুদিদের মধ্যে একেবারে তৃণমূলে রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন ইহুদিদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। শুধু ইহুদি নয়, কট্টরপন্থী খ্রিষ্টান ইভানজেলিক গির্জা থেকেও তারা তহবিল সংগ্রহ করে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়