ঢাকা, বুধবার   ০১ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাংলা ভাষণ

জায়েদুল আলম

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২  

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

আজ ঐতিহাসিক ২৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৪ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। আজ দিবসটির আটচল্লিশতম বার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দেওয়া এই ভাষণের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য সব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, জানতে পারে বাংলাভাষী জাতির জন্য রয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার নাম বাংলাদেশ।

ওই শতাব্দীর শুরুতে ১৯১৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পরিচয় করান। তার ছয় দশক পর বাঙালি জাতির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে আবারও বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। 

আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৪-এর ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬-তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই অর্জন মূলত বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্যেরই প্রতিশ্রুতি। এরপর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর সফরসূচি ঠিক করা হয়। সেই হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর, সোমবার সকাল সাড়ে ৭টায় বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ২৪ সদস্যের সফরসঙ্গীসহ বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করেন।

ওই সময় জাতিসংঘে ছয়টি ভাষায় ভাষণ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। এ ছয়টির মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাভাষী এই নেতার বাংলা ভাষণ শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা মুগ্ধ হন। ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বিশ্বনেতারা নিজ আসন থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন ও আলিঙ্গন করেন। বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দেওয়া সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণের ইংরেজি অনুবাদটি পাঠ করেছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী। বিষয়টি ছিল এমন বঙ্গবন্ধু একদিকে বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে তা তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠ করেছেন।

বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম যখন ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পিনপতন নীরবতার মধ্যে তার স্বভাবসুলভ সাবলীল ভাষায় দৃপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন “আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির অংশীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং স্বাধীনতা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।’’

আগামীদিনের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন-“...আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার ওপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংস, ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব, যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে। যে অর্থনৈতিক উত্তেজনা সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়াছে তাহা একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া জরুরিভাবে মোকাবিলা করিতে হইবে।”

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন “বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপস মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করেছি।” পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। বলেন- “আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান রাখবে।”

পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বলেন “মানুষের অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রেখে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতেছি। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি, আমাদের স্বনির্ভরতা।”

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দিয়ে বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, সেই ভাষণের আটচল্লিশতম বার্ষিকীতে- ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়