ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

সাহিত্যে একাডেমিপনা এবং চিরায়ত সাহিত্য

আরিফুল হাসান

প্রকাশিত: ১২:৫৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যকে আজকাল একাডেমিক বিষয় হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। অথচ সাহিত্য কিন্তু মুক্ত। চার দেওয়ালের অধীন নয়। মুক্ত বিহঙ্গের মতো সে ডানা মেলে দেয় সুনীল আকাশের মেঘে মেঘে। যদিও বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যেও পরিবর্তন এসেছে বিস্তর, তবু হাজার বছরের ঐতিহ্য ভেঙে বাংলা সাহিত্য যে এত দ্রুত বিধ্বস্ত হয়ে যাবে, তা হয়তো কেউই প্রত্যাশা করেননি। সাহিত্যের একটা উন্মাদনা আছে, এই উন্মাদনা আসে স্বজ্ঞা থেকে। অপরদিকে উদ্দীপনা তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিকে শুধু বিজ্ঞই করতে পারে; প্রকৃত প্রস্তাবে সৃষ্টিশীল করতে পারে না। তাই সাহিত্যের শিক্ষা শ্রেণিকক্ষে নয়, বিপুল বিস্তৃত প্রকৃতিই তার আসল পাঠশালা।

প্রকৃতিকে পড়তে হলে মানুষের ধ্যান দরকার হয়। আর ধ্যান কখনো শিক্ষামূলক বিষয় নয়। একেবারে ভেতর থেকে না জাগরণ ঘটলে, একেবারে মূলের মধ্যে বড় কোনো ঝড় বয়ে না গেলে সাধকের সিদ্ধি লাভ হয় না। তাই তাকে হতে হয় মৌলিক; একেবারে নিজের মতো। অন্যের দেখানো পথ ধরে, অন্যের পায়ে চলার পথ মাড়িয়ে কেউ কোনোদিন সাহিত্যিক হতে পারেননি, অদূর ভবিষ্যতেও পারবেন না। সাহিত্যের ক্ষেত্রে শেখার কিছু নেই। লোকে বলে, ভাষা, ভাষার ব্যবহারটা তো অন্তত শিখতে হবে! কিন্তু না, এই ভাষারূপটাও থাকে লেখকের নিজস্ব আর বর্ণনাভঙ্গিটাও তার স্বজ্ঞাপ্রসূত। না হলে জসীম উদদীন এত বড় কবি হতেন না গ্রামের মুর্খদের ভাষা লিখে। আঞ্চলিক যে প্রবাদ, যা আমাদের সাহিত্যের মর্যাদার ঘরে বাড়তি হিরে যোগ করে, সেগুলোরও ভাষাভঙ্গি একান্ত মৌলিক। আবার ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের ভাষা; সমকালীন অন্যসব প্রচল আধুনিকতার থেকে তাঁর ভাষা সহজেই আলাদা করা যায়। কারণ ভাষাভঙ্গি শেখার ক্ষেত্রে তিনি তৎকালীন প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। নজরুলের ভাষাটাও সেরকম। বলা যায়, সময়কে অভিঘাতে অভিঘাতে ভেঙেচুড়ে সময়ের ভাষাটা রপ্ত করাটাই লেখকের কাজ। প্রতিষ্ঠানের কাজ আবার ভিন্ন। তারা করে সমকালীন ভাষার চাষাবাদ, আর লেখক করেন মূল ভাষার অনুরাগ সাধনা। তাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কলম তুলে ধরতে নজরুলকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে হয়নি। তিনি যেসব বই-পুস্তক পড়েছেন; সেখানেও এত আগুনের স্ফুরণ হয়তো ছিল না। এ আগুন তাঁর নিজস্ব, একান্ত আন্তরিক অনুধ্যান।

আমাদের সাহিত্যে প্রাতিষ্ঠানিকতা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারের টেবিল, বিভিন্ন সেমিনারের আলোচনার বিষয়বস্তু আর বিভিন্ন কর্মশালার কর্মীরাই মূলত বড় সাহিত্যিক। তাদের ধারে কাছে ভেড়া ভার। একেকজনের এমন হামবড়া ভাব যে সাহিত্যকে মনে হয় তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে নিজের জমিদারি বানিয়ে রেখেছেন। এতে মূলত ক্ষতি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। ফাঁকতালে জিতে গেছে ব্যর্থ, অশিক্ষিত আর অর্ধাঙ্গ ব্যাধিতে আক্রান্ত আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। তবু প্রতিষ্ঠানের দিকেই আমাদের যাত্রা। আর এ যাত্রা আমাদের নিয়ে গেছে অন্ধ বন্দিতায় এবং করেছে অবমুক্তির আনন্দ লুট।

শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও যদি ধরি বড় বড় সব সাহিত্যিক-কবি মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক। হ্যাঁ, কখনো কখনো লেখক নিজেও প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন এবং সেটিই দরকারি। কিন্তু গড়পরতায় যদি বলি তাহলে বিশ্বসাহিত্যে স্থায়ী আসন গেঁড়ে রাখা সব ক’জন মহান লেখকই ছিলেন স্বাধীনচারী। আর বিরল কিছু উদাহরণ হয়তো পাওয়া যায়, যারা প্রতিষ্ঠানে থেকেও নিজের সাধনার জায়গাটিকে স্থির ও লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত না হলে তারা হয়তো আরও আলো ছড়াতে পারতেন সভ্যতার অন্ধকার যুগে।

লিয়েভ তলস্তয়কে জানি, একজীবনে কতটা ক্ষ্যাপা আর কতটা উন্মূল ছিলেন ভেতরে ভেতরে। আবার কাফকার কথাই যদি ধরি, কী নিষ্ঠুর পাষাণ খেলা খেলেছেন নিজের জীবনের সঙ্গে! হ্যাঁ, চাকরি কিন্তু জীবনানন্দকেও করতে হয়েছে। তিনি করেছেন জীবনের জন্য। লেখালেখি থেকে পর্যাপ্ত অর্থ না আসলে জীবনধারণের তাগিদে লেখককে তো কোনো পেশা বেছে নিতেই হয়, তাই বলে এটিও জানি যে অধ্যাপনা জীবনানন্দের জীবনকে শুধু আনন্দহীনতাই দিয়েছে, কোনো রকম সহযোগ হতে পারেনি। আবার যদি আল মাহমুদের কথা বলি, সোনালি কাবিন লেখার আগেও তার আরও কিছু বই হয়েছে। লোক লোকান্তর ও কালের কলসে তিনি তার ভাষাকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ঠিক নিজস্বতাকে খুঁজে পাননি তেমন। ফলে উৎকর্ষতার চেষ্টা করেও শেষমেষ সোনালি কাবিনই তার বিখ্যাত কাব্য হয়ে থেকে যায়। ও দুটোতে তিনি কবিতার স্বর, ভাষা, প্রকাশভঙ্গিকে মানসম্পন্ন করার চেষ্টা করেছেন অর্থাৎ অবিদ্যাবিমোহন তার তখনও তৈরি হয়নি। তিনি বিদ্যায়তনিক পথে হাঁটার চেষ্টা করে দেখেছেন—না, অবিদ্যা বিমোহিত ভাবোপলব্ধিই সত্যের চাষাবাদ।

রুশ সাহিত্যের আরেক মহান লেখক ফিউদোর দস্তয়ভস্কি চাকরি জীবনে প্রবেশ করেছেন। এ প্রবেশ করা তাঁর একান্ত ইচ্ছে অনুযায়ী হয়নি। তার পিতামাতা তাকে এবং তার ভাইকে সাংকৃত পিতেরবুর্গের নিকলায়েভ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান, যা তাকে সামরিক কর্মজীবন শুরু করতে বাধ্য করে। ফলে কমিশন লাভ করার পরের বছর লেফটেন্যান্ট পদ লাভ করার পরেও তিনি নিজেকে কর্মজীবনের কর্মময়তার সাথে যুক্ত করতে পারেননি। রিজেনকাম্ফের একটি মন্তব্যে পাওয়া যায়—‘তার ভাইয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম ভালো ও ভদ্র নয় সে। কিন্তু যখন তার মনের ভাব খারাপ থাকে তিনি প্রায়ই সবকিছু তিক্তভাবে দেখেন, উত্ত্যক্ত হয়ে যান, সদাচার ভুলে যান এবং আত্মসচেতনতা ভুলে যান।’ এই আত্মসচেতনতা ভুলে যাওয়াই সাহিত্যের মেডনেস, প্রতিভার বিষ। প্রতিষ্ঠান এই মেডনেসেরই বিরোধিতা করে, নিরস্ত্র করে সাহিত্যের উন্মাদনাকে। অথচ যা উন্মাদনা, তা-ই জ্বলে ওঠার বারুদ।

প্রতিষ্ঠান বলতে আমি প্রচলিত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলছি না। ওসব ছোট কাগজ, বড় কাগজের দ্বন্দ্ব শ্রেণিবৈষম্যেরই একটি অংশ। আমি বলছি, সাহিত্য-শিল্পের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাহিত্যে মোড়লপনার বিরুদ্ধে। আমাদের সাহিত্য হলো কি হলো না, তা ইতিহাসের অন্যপাঠ দিয়ে নিরূপণ করেন সাহিত্যের অধ্যাপকেরা। ছন্দ-তত্ত্ব-মাপকাঠি ইত্যাদি দিয়ে বিস্তৃতির জায়গাকে করেন কুণ্ঠিত। ফলে যা কিছু স্বতসিদ্ধ তা-ও তখন হয়ে ওঠে মেকি, পার্লারাইজড করা। এই পার্লারাইজডকরণই বাংলা সাহিত্যের প্যারালাইজডের কারণ।

সম্প্রতি কিছু লোক আবার জোট করে কবিতার কর্মশালার নামে কবিতা শেখানোর নানা ফন্দি-ফিকির করছেন। যেন কোনো প্রকল্প—তারা লেখক তৈরি করবেন। এটিও এক ধরনের রুচির ওপর কাঁচি চালানোর মতো। আপনি যা শিখেছেন, যেভাবে কবিতার সংজ্ঞা শিখেছেন, নতুন কবিতা তো সেরকম না-ও হতে পারে। একেবারে আনকোরা কিছু না হলে তো আর নয়া কবিতা বলা যায় না। ওসব গতানুগতিক ছকবাঁধা কথা চেষ্টা করলে অনেকেই লিখতে পারেন। বলছি—হাতের আঙুলে ছন্দ গুণে কবিতা হয় না। হ্যাঁ, কবিতার জন্য ছন্দজ্ঞান অবশ্যই দরকার, তবে তা প্রবাহ ও ভাবের বিস্তারকে বাধাগ্রস্ত করলে তার চেয়ে ও জিনিস না শেখাই ভালো।

আমরা মনে করি, কবি হলে আর তিনি যদি নামিদামি প্রতিষ্ঠানের কেউ হন, তাহলে তার মতো পণ্ডিতজন আর কেউ হয় না। না, পাণ্ডিত্য আর সৃজনশীলতা এক কথা নয়। সৃজনশীলতার জন্য ওসব পাণ্ডিত্যের পথ ছেড়ে দেওয়ার নজির বহু আছে। বরং যারা জীবনে পাণ্ডিত্যের গতিপথ মাড়াননি, তাদের মধ্যেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকগণ তৈরি হয়েছেন। অপরদিকে পাণ্ডিত্যের পথে হাঁটতে গিয়ে অনেক সৃষ্টিশীল সম্ভাবনাময় কবিরও ধূলিস্মাৎ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ অহরহ। তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের আবদ্ধতা নয়, নিতে হবে উন্মুক্ত পৃথিবীর উদার অনাবিল পাঠ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়