ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

শিলারি: হাওরপাড়ের জীবন্ত আখ্যান

শাহ ইয়াছিন বাহাদুর

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ২৯ মে ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দাঁতাল বৈশাখ যখন দাঁত বসায়, যখন হাতির শুঁড়ের মতো পানি উড়ে যায় আসমানে, তখন মংগলচরণের চোখ দায়ের কোপে শিলা কেটে, ভেঙে খানখান করার কল্পনায় ছলছল করে ওঠে এবং মোষের শিঙে তৈরি শিঙা নিয়ে আসন্ন শিলার পতন ঠেকাতে মাঠে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। মংগলচরণ খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দু’হাত আকাশের দিকে তাক করে মন্ত্র পড়ার নেশায় সারাটা বছর অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে কখন কাঠফাটা রোদের নির্দয় চৈত্রের শেষে বৈশাখ আসবে, কখন মুসলমান পাড়ায় বৃষ্টির এস্তেস্কার নামাজ হবে, ডেকচি ভরা শিরনি হবে, কখন গেরস্থের বউ-ঝিরা দিশেহারা হয়ে আয়োজন করে ব্যাঙের বিয়ে দেবে।

মংগলচরণ বৈশাখের অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে তার স্ত্রী শৈলবালাও। শৈলবালার কণ্ঠে যখন আক্ষেপের সুর, ‘হায় ভগবান, সারাডা বছর যদি বৈশাখ মাস হইতো!’ তখন মংগলচরণও স্বীকার করে, ‘হ হ শৈল। এইভাবেই কথা কইও। বৈশাখ যেন সারা বছর বিরাজ করে।’

মংগলচরণ বংশপরম্পরায় বৈশাখের ঝড়ো হাওয়াময় দিনে শিলাবৃষ্টি ঠেকাতে মুহুর্মুহু মন্ত্রপাঠে আকাশের সঙ্গে এক অতিপ্রাকৃত খেলা করে। কখনো আকাশ তার মন্ত্রপাঠে সর্বনাশা শিলাপতন থামিয়ে দেয়, কখনো দেয় না। আর এ কারণেই গুরুচরণ দাসের পুত্র সাধুচরণ দাস, তার পুত্র রায়চরণ দাস, তার পুত্র মংগলচরণ দাস, তার পুত্র হরিচরণ যখন ঘুড়ি ওড়াবার কথা বলে; তখন মংগলচরণ উৎসাহ দেয়, ‘ঘুড়ি উড়ানো খুব ভাল। এই একই কথা। আসমান নিয়ে খেলা করা। এমন করতে করতেই একদিন শেখা হয়ে যাবে ঘুড়ির আশির্বাদে। যাও যাও ঘুড়ি উড়াও আসানপুর, দিঘীরপাড়, পাটলি আর বোয়ালি শিবপুরের আসমানে। যেমন কইরা সাদা কাল মেঘেরা পরমেশ্বরের আশির্বাদে উড়ে আবার পড়ে। ঘুড়ির মত গোত্তা খায়। যাও বাতাসের বেগ চিইনা লও।’

মংগলচরণের আসমান-আসমান খেলার অংশজুড়ে থাকে স্রোতাল ঘোড়াউত্রা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর-ইটনা-মিঠামইন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও গ্রামের হিন্দু-মুসলিম তাবৎ মানুষ। এসব অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্যবতী বোরো ধানের স্বপ্নে বিভোর থাকে। বোরো ধান গোলায় উঠলে ছেলের পড়ার খরচ হয়, মেয়ের বিয়ে হয়। হয় সারাবছরের খোরাকি। ওরা হাওর ঠেলে নাইওর যায়, নাইওর আসে। বেংলা নামক বিলে ‘কাল কুচকুচে শ্যাওলা পড়া রুইমাছ’ ধরে। নদী আর বিলের দখল নিয়ে মারামারি করে রক্তাক্ত হয়। আর এসবের মাঝেই তুমুল বৈশাখে আমরা মংগলচরণকে দেখি। দেখি, স্ত্রী শৈলবালা, গরু-হাঁস চড়ানো, শামুক কুড়ানো একমাত্র কন্যা যশোধা ও পুত্র হরিচরণকে নিয়ে মংগলচরণের ছোট সংসার।

ভূমিহীন শিলারি মংগলচরণের আকাশের সঙ্গে লড়াইয়ের চিত্রটা ভারি অদ্ভুত। আকাশ যখন তারস্বরে ডাকতে আরম্ভ করে, বাজিতপুরের আকাশ যখন দিকে দিকে কালো মেঘ বিছিয়ে দিতে থাকে, মংগলচরণ তখন কী এক নেশায় পরিবারের অনুরোধ উপেক্ষা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। ততক্ষণে ঘড়ঘড় শব্দে মাটি কাঁপানো আসমান মরিয়া হয়ে উঠলে হয়তো আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়, হয়তো একটা একটা করে শিলাবৃষ্টিও পৃথিবীকে ঘাই মারতে মারতে ভূমিতে এসে লকলক করে হাসতে থাকে।

একদিন আকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করে। বাতাসও খুব জোরে বয়। হাওরের মানুষ আকাশের এ রূপ দর্শনে ‘আল্লাহর গজব’ ভেবে ভয় পেলেও মংগলচরণ ভয় পায় না। মংগলচরণ শিলাপতন ঠেকাতে তারই হাতে ‘লাল নিশান উড়িয়ে বেঁধে আসা’ মাঠে ছুটে যায়। তখন শুরু হয় সীমাহীন আকাশের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক শিলাযোদ্ধার অসম লড়াই। বাতাসের বেগ আরও বাড়ে। খোলা ময়দানে মংগলচরণ তখন তার পরনের লুঙ্গি শূন্যে ছুঁড়ে মেরে গামছা দিয়ে নেংটি বানিয়ে নেয়। মংগলচরণ নানা মন্ত্র পড়তে থাকে। “দূর্গা দিছে মন্ত্র/শিবে দিছে বর/ এই মন্ত্রে শিলাবৃষ্টি পানি হইয়া পড়/ দোহাই ধর্মের দোহাই শিবের/ দোহাই শিবের/ শিবায় নমঃ।”

সে বার মন্ত্রপাঠে আর কাজ হয় না। প্রচণ্ড শিলাপতনের কবলে পড়ে মাঠ ছেড়ে মংগলচরণ রেনু মিয়ার বাথান ঘরে আশ্রয় নেয়। শিলার আঘাতে যখম হয় সে এবং শিলাবৃষ্টি ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় পরক্ষণেই গ্রামের মানুষের ক্রোধেরও শিকার হয়। শিলার সঙ্গে ব্যর্থ যুদ্ধের পর সে এই প্রথম গেরস্থের দলের আক্রমণে পড়ে। ক্রোধে উন্মত্ত কেউ তখন মংগলচরণকে দুয়েকটা কিলঘুষি মারে। কেউ একজন তাকে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। সে ঘরের মেঝে থেকে জমির ওপর ছিটকে পড়ে। একজন তার মাথায় বাড়ি দেয় আর তখন তার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকে। জমির মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিলার উপর তার ঝরা রক্ত অদ্ভুত রং ধারণ করে।

মংগলচরণকে আঘাতকারী গেরস্থরা মৃত ভেবে ফেলে গেলে সে যাত্রায় বেঁচে যায় এবং কোনোমতে ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবে, পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত এ শিলাবিদ্যা ছেড়ে দেবে। কিন্তু একবার তার বালিকাকন্যা যশোধা যখন মংগলচরণের স্ত্রী-পুত্রের সামনে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, তুমি খালি মাইনষের ক্ষেতের ধান আন। নিজের ক্ষেত করতে পার না? আমরার কি জমি নাই?’ এরপরই এক গেরস্থ তাকে শিলা ঠেকাবার পুরস্কারস্বরূপ এবার তাকে অনেক ধানের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটা এতই লোভনীয় যে, যা দিয়ে সে একখণ্ড জমিও কিনে নিতে পারে! গেরস্থের আশ্বাসে তখন মংগলচরণের মন চনমন করে ওঠে।

গেরস্থের সঙ্গে মংগলচরণ চুক্তিটা পাকা করে ‘এইবার আমার কামের মইধ্যে কোনো ফাঁক ফোঁকর রাখবো না’ বলে স্ত্রী শৈলবালাকে আশ্বাস দিয়ে নবউদ্যমে তার জোগাড়যন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এবং মংগলচরণের মুখে অনবরত মন্ত্রপাঠ চলতে থাকে। “ঈশ্বর মহাদেবের মাথা খাও/ যদি জ্ঞান নড়ে/ ঈশ্বর মহাদেবের জটা ছিঁইড়া ভূমিতে পড়ে।” মন্ত্রপাঠ চলতেই থাকে। ইত্যবসরে বৈশাখের আকাশ তার ধারালো দাঁত উন্মোচন করে দিকে দিকে শিলা ছড়িয়ে দিতে থাকে। মংগলচরণের জেদ চাপে। খোলা জমিনের দিকে সে ছুটে যায়। তখন বড় আকারের একটা শিলা তার মাথায় আঘাত করলেও সে দমে যায় না। তার মনের গহিনে হয়তো তখন অনেক অনেক ধানপ্রাপ্তির চুক্তিটা নড়ে ওঠে। হয়তো এর দ্বারা একখণ্ড জমিপ্রাপ্তি অথবা সারাজীবনের এই আসমান-আসমান আর শিলা-শিলা খেলাটার সমাপ্তির কথা মাথা চাড়া দেয়। ফলে মংগলচরণ থামে না। শিলাপতনের তীব্রতা আরও বাড়ে। তখন মংগলচরণের একটি পা খাদে পড়ে গেলেও সে আর উঠতে পারে না। বিরামহীন শিলাপাতের ওই মুহূর্তে তার আরেকটি পা-ও শক্তি হারিয়ে ফেলে। মংগলচরণের আপাদমস্তক উপর্যুপরি শিলার আঘাতে পিষ্ট হয় এবং একসময় ছোট-বড় বরফখণ্ড তাকে ঢেকে ফেলে। মংগলচরণের আসমান বা আসমান থেকে পতিত শিলার সঙ্গে বাৎসরিক যুদ্ধটার এখানেই সমাপ্তি হয়। মংগলচরণ দেহত্যাগ করে।

মংগলচরণের শিলারি হয়ে ওঠা এবং আসমান ও শিলার সঙ্গে তার একতরফা মৌসুমী যুদ্ধের নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা নদীপাড়ের প্রাচীন জনপদ বাজিতপুরের নানা গ্রামের নানা মানুষের আচার-আচরণ ও হাওরাঞ্চলের বৃষ্টি, হাওরবাসীর সনাতন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে কখন যে আমরাও শিলারির কাছের কেউ হয়ে উঠি, টের পাই না। মংগলচরণের সরল সংসার ও সংসারী লোকদের সঙ্গে তার সরল আলাপে তার প্রতি বড় মায়া হয়। মংগলচরণের চারপাশে ঘটমান প্রতিটি ঘটনা মূলত হাওর এলাকার সত্যিকারের গল্পগাথা যা যুগযুগ ধরে উল্লেখিত জনপদকে নানামাত্রিক দুঃখ-সুখে বিভোর করে রেখেছে।

নাট্যকার ‘গোলাম শফিক’ শিলারি মংগলচরণের মাধ্যমে ফসল ফলানো চিরায়ত কৃষককূলের আবহমান যে চিত্র নাটকের অনুষঙ্গ বোলাম-পয়ার-কথা-কথকতায় তুলে আনলেন; তা এক কথায় অভাবনীয়। হাওরপাড়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি নিপূণভাবে মেলে ধরেছেন এ অঞ্চলের শব্দ ও ভাষাশৈলীর স্বাতন্ত্র্য। প্রতিটি চরিত্রের প্রতিটি সংলাপে অঞ্চলের কথ্যরূপ প্রতিবার যখন স্বার্থকতায় ধরা দেয়, তখন শুনতে বড় ভালো লাগে। আরো ভালো লাগে তাঁর মধুর বর্ণনাভঙ্গী, “বায়ে এক সুন্দর গেরাম। যেমন কচুপাতায় জল সুন্দর। কপালে সিঁদুর সুন্দর। ধলপহরের আসমানে এক সূর্য সুন্দর। যেমন মরে যাওয়া বীরের বুকে শত্রুর হাতের ঘাই সুন্দর। দাঁতে ছুঁয়ে মাটি আবার টান টান সিনা সুন্দর। তেমন সুন্দর এই গেরাম। ঐ দেখা যায়।”

সর্বশেষ
জনপ্রিয়