মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা
অনলাইন ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
গত চার দশক ধরে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে। পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে রাষ্ট্র ও উগ্র বৌদ্ধদের নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। ১৯৭০ সাল থেকেই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ এই ভূখন্ডে আশ্রয় নিতে শুরু করে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আসে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের শিকার হয়ে আসে আরও ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে আবার নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরেও গেছে। বেশিরভাগই রয়ে গেছে বাংলাদেশে।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের হামলা ও গণহত্যার ঘটনায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও পরে শুধু মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। এ সময় বাংলাদেশে আসে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। এদের সঙ্গে আগে থেকেই অবস্থানকারী মিলে বাংলাদেশ এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আবাসভূমি। এদের প্রায় ছয় লাখ আছে শরণার্থীদের জন্য নির্মিত কুতুপালং মেগা শিবিরে।
অনেক শরণার্থীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভাসানচরে। মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। তাদের ভরণ-পোষণের পাশাপাশি কক্সবাজার এলাকার পরিবেশ দূষণ বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এদের অনেকে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশীদের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। জঙ্গি তৈরি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিতে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলোতে।
রোহিঙ্গা মিয়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি। মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ এদের বাংলাদেশের অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বাস করে আসছে। হঠাৎ করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে। মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বলছে। মিায়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্বই স্বীকারই করতে চায় না। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের একটি বোঝা।
এই শরণার্থী শিবির নিয়ে মাঝে মধ্যে সরকারকে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক চাপ এবং নিরাপত্তা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। নিকট ভবিষ্যতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি। আন্তর্জাতিক চাপ ও কয়েকটি সংস্থার মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে সরকারের অনেক আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকের জের ধরে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয় এবং একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপও গঠন করা হয়।
সমঝোতা স্মারকে দুই পক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে। তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। দেশ দুটি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয় ২০১৮ সালের নভেম্বরে এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে। বাস্তবে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইলেও সমস্যা দেখা দেয় মিয়ানমার সরকারের নানা শর্ত নিয়ে। রোহিঙ্গা নেতারাও তাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে কিছু পূর্বশর্ত আরোপ করেন। এগুলো অনেকাংশে যৌক্তিক হলেও তাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা চলাকালেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা, অত্যাচার অব্যাহত রেখেছে। মিয়ানমার সীমান্তে এখনো যে কজন রোহিঙ্গা রয়েছে, তাদের ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। এদের অনেকেই অভিযানের মুখে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ অবশ্য স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছে, আর কোনো রোহিঙ্গা স্মরণার্থীকে এই ভূখন্ডে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
সংকট নিয়ে এমন একটি পরিস্থিতিতে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প হয়ে উঠেছে সংঘাতময়। আধিপত্য বিস্তারের জেরে কক্সবাজারের ৩২টি ক্যাম্পে একে অপরের ওপর হামলা করছে বিদ্যমান সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো। রোহিঙ্গারা ভ্রাতৃঘাতী হওয়ায় প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর একটি সশস্ত্র গ্রুপের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়েছে এক রোহিঙ্গা যুবক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কিছু গ্রুপ অনৈতিক সুবিধা পেতে ক্যাম্পে সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করছে।
যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদেরও তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় সমতল ভূমির মতো অভিযান চালানো যায় না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। প্রশাসন যাই বলুক রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা বলে অনেক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে ক্যাম্পে। তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলে রোহিঙ্গাদের দলে টানছে। দল ভারি করার নেপথ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসা। ক্যাম্পের অবস্থান ধরে রাখতে নিজেরাই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ক্যাম্পেই একে অপরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, আধিপত্য বিস্তারের জেরে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমপক্ষে ১১৮টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত চার মাসে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক। রিপোর্টে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সক্রিয় ছোট বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে শতাধিক।
এ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর একেকটিতে আবার সদস্য রয়েছে সর্বনিম্ন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন। গ্রুপগুলোর ছোট বড় সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, অপহরণসহ ১২ ধরনের অপরাধ করছে এরা। ক্যাম্পে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রায়ই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সাধারণ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর পাশাপাশি সক্রিয় মিয়ানমারভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনগুলো। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ এবং জমিয়াতুল মুজাহিদিনের পাশাপাশি নতুন করে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন। মাস্টার মহিবুল্লাহ খুনের পর আরসা ক্যাম্পে কোণঠাসা থাকলেও ফের তারা অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চারজন মাঝি খুনের ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে মোহাম্মদ হাশিম নামে এক রোহিঙ্গা যুবক। পিস্তল হাতে নিয়ে এই যুবক ফেসবুক লাইভে এসে নিজেকে ‘ইসলামী মাহাজ’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য বলে দাবি করে। হাশিম বর্ণনা দিয়েছে, কিভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চার মাঝিকে হত্যা করা হয়। সে জানায়, তার মতো আরও ২৫ জনকে অস্ত্র দিয়েছে ইসলামী মাহাজ। দেয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।
তাদের কাজ হত্যার মিশন বাস্তবায়ন। চারজন মাঝি আজিম উদ্দিন, সানা উল্লাহ, জাফর ও ইসমাইলকে তারাই হত্যা করেছে। ইসলামী মাহাজের ছয় মুখপাত্রের নামও উল্লেখ করেছে সে। সামনে তাদের আরও বড় মিশন ছিল। হাশিম এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে এই খারাপ জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতার পেছনে শুধু আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা মাদক ব্যবসাই জড়িত নয়, রয়েছে সমাজের ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত জঙ্গি তৎপরতা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অসহায়ত্ব, অভাব ও ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী ক্যাম্পগুলোতে তৎপরতা শুরু করেছে। এরা রোহিঙ্গা যুবকদের বিভ্রান্ত করে কাজে লাগাতে চায়। মগজ ধোলাইয়ের পাশাপাশি যুবকদের টাকা ও অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুলছে সন্ত্রাসী গ্রুপ। ভবিষ্যতে এদের কাজে লাগানো হবে ক্যাম্পের বাইরে জঙ্গি কার্যক্রমে।
রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত করা ক্যাম্পের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয় নয়। অর্থ, অস্ত্র ও ইন্ধন জোগান দেওয়া হচ্ছে বাইরে থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাইরের এই অশুভ শক্তি কারা। নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে কিভাবে এরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এরা রোহিঙ্গাদের মগজ ধোলাই করে অস্ত্র-অর্থ জোগান দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অতি দ্রুত এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হবে।
স্বেচ্ছায় তথ্য প্রকাশকারী যুবককে কাজে লাগিয়ে উদ্্ঘাটন করতে হবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গি কার্যক্রমের নীল নকশা। দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি করতে হবে নীল নকশার সঙ্গে জড়িতদের। একই সঙ্গে খুঁজে বের করতে হবে মাদক ব্যবসার রুট ও চক্র। না হলে মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পই হয়ে উঠবে মাদক ও সন্ত্রাসের সূতিকাগার এবং জঙ্গি তৈরির কারখানা।
- পদ্মা সেতুতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় হবে মাত্র তিন সেকেন্ডে
- Turkey donates sea ambulance for Rohingyas in Bhasanchar
- পদ্মা সেতুর তেলেসমাতি: শরীয়তপুরের জমি এখন স্বর্ণ
- স্মার্ট বাংলাদেশ: পথচলা ও রূপরেখা
- স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে বঙ্গবন্ধু টানেল
- কালনা সেতু: দেশের প্রথম ৬ লেনের সেতু
- ১৫ লাখ কৃষককে বিনা মূল্যে সার-বীজ
- পদ্মাসেতুর কারণে কমছে দুরত্ব, ভোগান্তি ও ভাড়া
- মাত্র ৭ থেকে ৮ মিনিটেই পদ্মার এপার ওপার
- পদ্মাসেতুর টোলসহ ১৩ রুটের বাস ভাড়া নির্ধারণ করেছে বিআরটিএ