ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মঙ্গল গ্রহের কুয়া

শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ৪ জুন ২০২২  

প্রতীকী

প্রতীকী

ঠিক যেমন যথার্থ হতাশা বলে কিছু নেই, তেমনি যথার্থ লেখা বলেও কিছু নেই। কথাটা একজন লেখক আমাকে বলেছিলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায়। কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও কথাটার পূর্ণ অর্থ আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে কথাটিতে আমি শান্তনা খুঁজে পেতাম এই ভেবে যে, আসলেই যথার্থ লেখা বলে কিছু নাই।

ছেলেবেলায় লিখতে বসলেই আমি হতাশ হতাম। কারণ, লেখার যেটুকু বিস্তৃতি আমার নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিলো, তা ছিল যথেষ্টই সামান্য। যেমন হাতি সম্পর্কে কিছু লিখতে সমর্থ হলেও হাতির মাহুত সম্পর্কে আমাকে লিখতে বলা হলে আমি পরিপূর্ণ শুন্যতায় ভুগতাম। এধরণের একটা বৃত্তের ভেতরে আমি জীবনের একটা বড় সময় আটকা ছিলাম। প্রায় আট বছর।

‘আমাদের সকল অভিজ্ঞতাই শিক্ষামূলক’- এই নীতিতে কেউ যদি জীবন যাপন করে, তাহলে বৃদ্ধ হওয়াটা তার জন্যে বেদনাদায়ক নয়। এই ধরণের দর্শন অনুসরণ করতেই পরিচিত মানুষেরা আমাকে উপদেশ দিয়েছিল। বিশ বছর বয়স থেকেই আমি শিখেছিলাম ওপরের দর্শন অনুযায়ী জীবন যাপন করতে। সর্বতভাবে। ফলে আমি প্রতারিত হয়েছিলাম। লোকে আমাকে ভুল বুঝত। অনেকে  আমাকে ব্যবহার ও অপব্যবহার করত। বার বার। অবশ্য এটা আমাকে অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতাও দিয়েছিল। বিভিন্ন ধরণের মানুষেরা আমার কাছে আসত আমাকে তাদের গল্প বলতে। গল্প বলা শেষে হারিয়ে যেত চিরকালের জন্যে। কখনই ফিরে আসত না। মোটকথা আমি ছিলাম সাঁকোর মত যার উপর দিয়ে অতিক্রম করে তাদের পক্ষে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গমন করা ছিল সহজতর। আমিও অবশ্য এই পুরো সময়কালে মুখের জিপার টেনে রেখেছিলাম। অন্তত যতদিন না আমি ত্রিশ বয়সে পদার্পণ করি।

উপরোক্ত কথাগুলোর অর্থ অবশ্যই এই না যে, আমার সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল বা আমার সমস্যাগুলোর  অন্তত একটারও সমাধান করতে পেরেছিলাম আমি। এমনকি এমনও নয় যে, আমি নতুন কোন গন্তব্যে পৌঁছুতে  পেরেছিলাম। আসলে আমার হয়তবা কোন পরিবর্তনই হয়নি। ফলে এই লেখালেখি আমার জন্যে আত্মশুদ্ধির পথে কোন পর্যায়ে রূপ নেয়নি। শুধুমাত্রই ছিল গন্তব্যের দিকে আপাত যাত্রা। আসলে সততার সাথে লেখা যথেষ্টই দুষ্কর। আমি দেখেছি আমি যতোই সৎ হওয়ার চেষ্টা করেছি, ততই আমার শব্দগুলো অন্ধকারের ভেতরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলো।

উপরের বক্তব্যটুকু সত্য থেকে সরে যাবার জন্যে আমার কোন ওজর নয়। আমি নিশ্চিত যে, এখানে যে গল্পটা আমি পরিবেশন করেছি, তা গল্পটা আমি যতটা সম্ভব সত্য রূপে বলার চেষ্টা করেছি। তারপরেও আমি চিন্তামুক্ত নই।  তবে আমার বিশ্বাস সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কোন একদিন হয়ত আমার আত্না সত্যিকারের মুক্তি লাভ করবে মিথ্যা হতে। সেটাই হবে সেই সময়, যখন হাতিরা উন্মুক্ত তৃণভূমিতে ফিরে আসবে  করবে এবং আমি পৃথিবীর গল্পগুলো  বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর করে বলতে সক্ষম হব।

লেখালেখি সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার প্রায় অধিকাংশই আমি প্রাপ্ত হয়েছি ডেরেক হার্টফিল্ডের নিকট থেকে। তবে দুর্ভাগ্যজনক যে, লেখক হিসেবে তিনি ছিলেন নিষ্ফলা বা বন্ধ্যা প্রকৃতির। তার লেখার কিছুমাত্র পড়লেই আপনি তা বুঝতে পারবেন। যদিও তার গদ্যগুলো অভিনব  এবং ভাবনাগুলো ছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরণের। শব্দকে তিনি  ব্যবহার করতেন অসাধারণ অস্ত্র হিসেবে। শুধুমাত্র শব্দ দিয়ে আমরা তার যুদ্ধংদেহীতার স্বরূপ বিবেচনা করি, তবে আমার মতে তাকে তুলনা  করা যেতে পারে একই সময়কালের বিশ্বসাহিত্যের দুই মহীরুহ হেমিংওয়ে ও ফিটজেরাল্ড এর সাথে।  কিন্তু দুঃখজনক হল যে, হার্টফিল্ড কখনই উপলব্ধি করতে সক্ষম  হননি তিনি কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। চূড়ান্ত বিবেচনায় এটাই আমার কাছে  তার বন্ধাত্বের বা অনুর্বরতার একমাত্র কারণ বলে মনে হয়েছে।  

হার্টফিল্ড তার এই নিষ্ফলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন আট বছর দুই মাস সময়কাল ধরে। অতঃপর তিনি মৃত্যুকে বরণ   করে নেন।  ১৯৩৮ সনের জুন মাস। দিনটি  ছিল রবিবার। রৌদ্র করোজ্জল সকাল। এম্পায়ার  স্টেট বিল্ডিঙের উঁচুতলা থেকে তিনি লাফ দিয়েছিলেন। তার ডান হাতে ছিল এডলফ  হিটলারের পোর্ট্রেট, বাম হাতে ছিলো একটা খোলা ছাতা। কম সংখ্যক মানুষই তার এই মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেছিলো। ফলে জীবন যেমন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল,  মৃত্যুতেও তিনি তেমনি অজ্ঞাতই রয়ে গিয়েছিলেন। 

জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ার সময়ে হার্টফিল্ডের প্রথম বইটা আমার হস্তগত হয়। অনেক বছর  পূর্বেই এই  বইয়ের প্রিন্ট শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমার মনে আছে। কারণ ঐ সময়ে আমি  ‘ক্রচ রট’ নামের এক প্রবল ধরণের চুলকানি রোগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। বইটা আমার এক  চাচা আমাকে দিয়েছিলেন। বইটি হস্তান্তরের তিন বছর পর ক্ষুদ্রান্ত্রের  ক্যান্সার রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

ভালো  লেখা সম্পর্কে হার্টফিল্ড বলেছিলেন, “লেখালিখির প্রধান কাজ হল লেখকের নিজ ও চারপাশের পরিবেশের মধ্যে বিরাজিত দূরত্বকে যাচাই করা। এটা করার জন্যে  প্রয়োজন সংবেদনশীলতা নয়, প্রয়োজন একটা সঠিক  মাপকাঠির।” 

হার্টফিল্ড বর্ণিত মাপকাঠি নিয়েই আমি চারপাশের পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলাম। ভয়ে ভয়ে। সেটা ছিল  সেই বছর, যখন কেনেডিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আজ থেকে পনের বছর পূর্বে। মাপকাঠি  ব্যবহার করে এই পনের বছর সময়কালে আমি একটার পর একটা জিনিষ বর্জন  করেছি। ইঞ্জিনের সমস্যা আছে এরকম একটা উড়োজাহাজ যেমন করে তার অংশগুলো  বদলায়। প্রথমে ফেলে দিতাম উড়োজাহাজের মালগুলোকে। তারপর জাহাজের আসনগুলোকে   এবং সবশেষে জাহাজের ক্রুদের। এভাবেই আমি সবকিছু থেকে পরিত্রাণ নিয়েছিলাম।  বিনিময়ে হিসেবে নতুন কিছুই গ্রহণ করা হয়নি আমার।

কাজটা কি  সঠিক হয়েছিলো? আমি জানি না। জীবন তো আপাতভাবে সহজই। কিন্তু আতঙ্কিত হই  যখন  আমি চিন্তা করি বয়ষ্ক এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া নিয়ে। আমাকে আগুনে পুড়িয়ে  ফেলার পর আমার আদৌ কি কোন কিছু অবশিষ্ট থাকবে? কিছুই থাকবে না। এমনকি একটা  হাড়ের টুকরাও!

আমার দাদীমা আমাকে বলতেন, “ কাল অন্তরের মানুষেরা কাল স্বপ্ন দেখে। যাদের অন্তর আরো বেশি কালিমাময়, তারা স্বপ্নই দেখে না।”

যে রাতে তিনি মারা গিয়েছিলেন, সে রাতে আমি প্রথম যে কাজটা করেছিলাম তা হল  আমার নরম হাত দিয়ে যত্নের সাথে তার চোখ দুটো বুজে দেয়া। সেই মূহুর্তে তার সত্তুর বছরের জীবনের সকল স্বপ্নগুলো বিলীন হয়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের ভেতরে।  ঠিক যেভাবে গ্রীষ্মকালের বৃষ্টির ফোটা শুকিয়ে যায় উষ্ণ উঠোনের ওপরে।  কিছুই  অবশিষ্ট থাকে না।

লেখালিখি সম্পর্কে আমার শেষ কথা হলো যে, লেখালিখির ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষেই বেদনাদায়ক। এটাই আমার পর্যবেক্ষণ। একটা  পুরো মাস সময়কালে আপনি এক লাইনও লিখতে সমর্থ হতে নাও পারেন। আবার একনাগাড়ে  তিন দিন-তিন রাত প্রানান্তকরভাবে লেখালেখি  করার পর আপনি অবাক বিস্ময়ে  আবিস্কার করতে পারেন যে, আপনার লেখাতে প্রকৃত বিষয়ের পুরোটাই  অনুপস্থিত। একারণে যদিও আমি লেখালিখি পছন্দ করি, তদুপরি লেখার  মাধ্যমে জীবনের অর্থ খুঁজতে যাওয়াকে আমার নিকটে  পূর্ণ জীবনের সাপেক্ষে শুধুমাত্র জন্মদিনের কেকের সাথেই তুলনীয়  বলে মনে হয়।

তখন আমার কৈশোর। উপরের সত্য আবিষ্কার করার পর আমার রীতিমতো তড়িতাহত অবস্থা।  পুরো  এক সপ্তাহ সময়ের জন্যে আমি মূক হয়ে গিয়েছিলাম। একটা বাক্যও স্ফুরণও হয়নি  আমার। মনে হয়েছিল যদি আমি যথেষ্ট বুদ্ধি ধারণ করতাম, তবে সমগ্র পৃথিবীকেই আমি নিজের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করাতে পারতাম। এমনকি পার্থিব সকল মুল্যবোধকেও  উল্টিয়ে দিতে সক্ষম হতাম। এমনকি বদলে দিতে পারতাম সময়ের গতিপথকেও।

দুঃখজনক ভাবে এটাও ছিল আমার জন্যে একটা মিথ্যার ফাঁদ বা মরীচিকা। অনেক  যুগ সময় লেগেছিল আমার আসল সত্য অনুধাবন করতে। বুঝতে পারার পর আমি একটা শূন্য  নোটবই হাতে নিয়ে বইয়ের মাঝ বরাবর একটা ভার্টিক্যাল লাইন  টেনেছিলাম। রেখার বাম অংশে  অংশে তালিকা করেছিলাম অনুধাবন থেকে আমি কি কি লাভ করেছি। ডান অংশে আমি লিখেছিলাম কি কি আমি হারিয়েছি। আমার হারানোর  তালিকাটি হয়েছিল খুবই দীর্ঘ। এতে ছিল অনেক কিছু। যে জিনিসগুলো আমি পরিত্যাগ বা যা কিছু আমি ঘৃণা বা অবহেলা ভরে পদদলিত করেছিলাম। এমনকি কতগুলো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার আমি  হয়েছিলাম সেগুলোও। এতই  দীর্ঘ হয়েছিল এই তালিকা যে, আমি সবগুলোকে লিখতেও সক্ষম হইনি।

আমরা যা বুঝি বলে ধারণা করি তার সাথে বাস্তবে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে বিশাল ফারাক থাকে উপসাগরের বিশাল আয়তনের মতো। এর গভীরতাও পরিমাপ  করা সম্ভব নয়, যত দীর্ঘই আপনার মাপকাঠি হোক না কেন। ফলে তালিকা ব্যাতিত আপনাদেরকে আমার পক্ষে আর কিছুই দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আমার এই লেখা উপন্যাস,  সাহিত্য কিংবা শিল্প নয়। এটা শুধুমাত্রই একটা নোটবই। এর মধ্যখান দিয়ে  শুধুমাত্র একটা রেখা টানা আছে। অবশ্য নৈতিক কিছু হয়তো পেতেও  পারেন আপনি  এখানে।

আপনি যদি শিল্প বা সাহিত্যে আগ্রহী হন, আমি আপনাকে পরামর্শ  দেব গ্রীক সাহিত্য পড়ার জন্যে। শুদ্ধ শিল্পকলা শুধুমাত্র যে সকল সমাজে  দাস ব্যবস্থা আছে, সেখানেই সম্ভব। গ্রীকদের দাস ছিল। তারা যখন রৌদ্রালোকিত  ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমিতে শুয়ে থাকত, কবিতা লিখত অথবা গণিতের সমীকরণের  সাথে মল্লযুদ্ধ করত, তখন দাসেরা কাজ করত, ক্ষেত চাষ করত, খাবার রান্না করত, তাদের পাল তোলা জাহাজে দাঁড় বাইত। এভাবেই একমাত্র  প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি সম্ভব। 

আপনাদের মধ্যে যদি এমন কেউ থাকে যিনি  রাত তিনটার সময়ে নির্জন রান্নাঘরের ফ্রিজে হানা দিতে সক্ষম, আমার মতে তিনি  শুধুমাত্র পারবেন লিখালিখি করতে। আমি ঠিক সেরকম একজন মানুষ। 

হার্টফিল্ডের (Hartfield) ছোট গল্পগুলোর মধ্যে ‘মঙ্গল গ্রহের কুয়া’ (The Martian Wells) একটি বিখ্যাত ও ভিন্ন ধরণের লেখা। আমি অনেক দিন পূর্বে পড়েছিলাম। ফলে বিস্তারিত খুঁটিনাটি অনেক কিছুই ভুলে গেছি। তবে মোটামুটি সারাংশ নিম্নরূপঃ

‘মঙ্গল গ্রহের কুয়া’ এক যুবকের কাহিনী। সে মঙ্গল গ্রহের কুয়াগুলোতে ঘুরে বেড়াত।

উল্লেখ্য, মঙ্গল গ্রহে শত শত কুয়া আছে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল যে,  এই কুয়াগুলোর কোনটারই তলা নেই। এমনকি শত সহস্র বছর আগে এই কূয়াগুলো খনন করা হয়ে থাকলেও এগুলোতে জলের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়ে থাকে যে, মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীরাই কুয়া গুলোতে যাতে জল অথবা জলের সাথে কোনরুপ সংযোগ না থাকে তা নিশ্চিত করেছিলো। সুপরিকল্পিতভাবে।

তাহলে এই কুয়াগুলো তৈরির উদ্দেশ্য কি ছিল? আমরা জানি না। হয়ত কেউই জানে না। কারণ একমাত্র কুয়াগুলোকেই মঙ্গলের অধিবাসীরা তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন হিসেবে অন্যদের জন্যে রেখে গিয়েছে। তাদের কোন হস্তলিখিত ভাষা, বাসস্থান, খাদ্যগ্রহণের তৈজসপত্র, ধাতু, গোরস্থান, রকেট, নগর, কলাই ভাঙ্গানোর যাঁতা, কোনকিছুই কিছুই বর্তমান পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে পাওয়া যায়নি। এমনকি বেলাভূমির কোনো সমুদ্র ঝিনুক পর্যন্ত নয়।

পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আজ অবধি বিতর্কে লিপ্ত মঙ্গলের অধিবাসীদের অস্তিত্ত্ব নিয়ে। কারণ বর্তমান পর্যন্ত এমনকিছুই পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব যে, তারা কোন সভ্যতার অংশ ছিলো। কিন্তু তাদের কুয়াগুলোর নির্মাণশৈলী ছিলো আসলেই অসাধারণ। এমনকি শত-সহস্র বছর পরেও এদের আকৃতি যথার্থ রয়েছে। একটা ইট বা পাথরও এদিক সেদিক হয়নি।

অনেক অভিযাত্রী এবং বিজ্ঞানীরাই এই কুয়াগুলোর বিষয়ে সত্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছে। অনেকে চেষ্টা করেছে দড়ির আগায় কিছু বেঁধে দিয়ে কুয়াগুলোর তলা পর্যন্ত প্রেরণ করার। কিন্তু এগুলো এতোই অন্তহীন গভীর ছিল যে,  তারা কোন ধরনের সার্থকতাই অর্জন করতে পারেনি। কয়েকজন চেষ্টা করেছিলো দড়ি ছাড়াই নিজেরাই  এর তলদেশে পৌঁছাতে। তারা আর কোনদিনই মঙ্গলের পৃষ্ঠে ফিরে আসেনি। অন্তত এই যুবকের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত।

যুবক মূলত একজন মহাজাগতিক পর্যটক। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মহাকাশ জুড়ে পরিভ্রমণ করাই তার শখ। তবে মহাকাশের সীমাহীন বিশালতা ও নির্জনতা দেখতে দেখতে এক সময়ে সে খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং সিদ্ধান্ত নেয় মঙ্গল গ্রহের বুকে নামহীন অজ্ঞাত এক মৃত্যুকে বরণ করার। 

যুবক মঙ্গলের শরীর জুড়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুয়াগুলোর একটার ভেতরে অবতরণ করে। আশ্চর্যজনকভাবে কিছুদূর নামতেই তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তার পূর্বের সকল মানসিক বিষাদ অলৌকিকভাবে অন্তর্হিত এবং সকল মানসিক শ্রান্তি দূর হয়ে যায়।

যুবক কুয়ার উপরিভাগ হতে মাত্র আধা মাইল নীচে একটা সুড়ঙ্গপথ আবিষ্কার করে। মানবদেহের ক্ষুদ্রান্ত্রের ল্যাবিরিন্থের মতো এঁকেবেঁকে তা মঙ্গলের পৃষ্ঠের সমান্তরালে প্রবাহিত হয়েছে এই সুড়ঙ্গপথ। যুবক সিদ্ধান্ত নেয় এই সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করার। প্রবেশ করার পর আঁকাবাঁকা পথ অনুসরণ করে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। গন্তব্য সম্পর্কে তার কোনো ধারণা না থাকলেও সে শঙ্কিত হয় না।

এই অনির্দিষ্ট যাত্রায় যুবক সময়ের খেই হারিয়ে ফেলে। তার হাতের ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। তবুও সে চলতে থাকে। হাঁটতে থাকে অনির্দিষ্ট সময় ধরে। দুই ঘণ্টা বা দুই দিন। অথবা তার চেয়েও বেশী সময় ধরে।  আশ্চর্যজনকভাবে তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুই পায় না। এক অদৃশ্য চলার শক্তি পেয়ে বসে তাকে।

অতঃপর এক সময়ে যুবকের মাথার ওপরে উজ্জ্বল আলো ঠিকরে পড়ে। যুবক নিজেকে আবিস্কার করে সুড়ঙ্গপথের শেষপ্রান্তে। এখানে এসে সুরঙ্গপথটি আরেকটা কুয়ার সাথে মিলে গেছে। কুয়ার প্রবেশমুখের সন্নিকটে। হামাগুড়ি দিয়ে যুবক কুয়ার কিনারা বেয়ে মঙ্গলের পৃষ্ঠে উঠে আসে।

প্রথমে সে তাকায় তার সামনের অখন্ড বিশাল এক প্রান্তরের পানে। তারপর দৃষ্টি ফেরায় উপরের দিকে, সূর্যের পানে। এই সময়েই সে অদ্ভূত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে বাতাসের গন্ধ, সূর্য সবকিছুতেই। যদিও সূর্য ছিল ঠিক  তার মাথার উপরে, তবুও সে স্পষ্ট বুঝতে পারে যে এটা মধ্যাহ্নের সূর্য নয়; অস্তগামী সূর্য। নিবু নিবু ভাব নিয়ে কমলা লেবুর মতো আকাশের ভেতরে ঝুলে আছে।

“আর মাত্র ২৫০,০০০ বছর পরেই সূর্য বিস্ফোরিত হবে!” একটা কণ্ঠ ফিসফিস করে ওঠে যুবকের পাশ থেকে।
“২৫০,০০০ বছর। তুমি জান এটা খুব দীর্ঘ সময় নয়।” যুবক কাউকেই দেখতে পায় না। তার কাছে মনে হয়
বহমান বাতাস কথা বলছে তার সঙ্গে।

“কিছু মনে কর না। আমি প্রবাহমান বাতাস। আমাকে তুমি ‘মঙ্গলের অধিবাসী’ বলেও ডাকতে পার। কারণ শব্দটার ভেতরে একটা রিনরিনে ভাব আছে। যদিও শব্দ আমার কাছে কোন অর্থই বহন করে না।”

“কিন্তু তুমি তো কথা বলছ।”
“আমি? না, আমি কথা বলছি না। সব কথাই তোমার। আমি শুধুমাত্র বোঝার সুবিধার্থে তোমার মনের ভেতরে সঙ্কেত প্রেরণ করছি।”
“ঠিক আছে। তবে একটা কথা আমায় বল। সূর্যের কি হয়েছে?”
“সে বুড়ো হয়ে গেছে এবং মারা যাচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে তোমার বা আমার কিছুই করার নেই।”
“কিন্তু হঠাৎ কেন তার এই অকাল মৃত্যু ...”

“হঠাৎ? অকাল মৃত্যু? কখনই নয়। তুমি কুয়ার ভেতরে প্রবেশ করার পর ইতিমধ্যেই দেড় বিলিয়ন বছরকাল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ঠিক যেমন করে ‘সময় উড়ে যায়’ বলে তোমরা পৃথিবীর মানুষেরা বলে থাক। যে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে তুমি এখানে এসেছ তা আসলে প্রবাহিত হয়েছে মোচড়ানো সময়ের (Time Warp) পথ অনুসরণ করে। আমরা এগুলো তৈরি করেছি সময়কে পাশ কাটিয়ে ভ্রমণ করার জন্যে। সংক্ষিপ্ততম সময়ের ভেতরে বিশ্ব জগতের শুরু থেকে শেষ অবধি বিচরণ করার জন্যে। জীবন ও মৃত্যুর বাইরের জগতে আমাদের অস্তিত্ব/বাস। আমরা বহমান বায়ু।”

“আমি কি তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
“অবশ্যই।”
“কি শিখেছো তুমি এই অন্তহীন সময়ে?”

বহমান বাতাস হাসে। যুবকের চারপাশটা নড়ে ওঠে দমকা বাতাসে। অতঃপর পুনরায় জেঁকে বসে অন্তহীন নীরবতা। মঙ্গল গ্রহের প্রান্তর জুড়ে।

যুবক পকেট থেকে পিস্তল বের করে। অতঃপর নিজ মস্তকে তা স্থাপন করে ট্রিগার চেপে দিলো। শেষ করার পূর্বে ডেরেক হার্টফিল্ড সম্পর্কে আরো কয়েকটা কথা। হার্টফিল্ড জন্ম গ্রহণ করেন ১৯০৯ সালে। ছোট্ট ওহাইও শহরে তিনি বড় হয়েছিলেন। তার পিতা ছিলেন একজন নির্জন প্রকৃতির মানুষ। টেলিগ্রাফ অপারেটরের কাজ করতেন। মা ছিলেন স্থুলদেহী। পছন্দ করতেন জ্যোতিষবিদ্যা। খুব সুন্দর ও সুস্বাদু কুকি বিস্কুট তৈরি করতে পারতেন।

ছেলেবেলায় হার্টফিল্ড নিজেই ছিলেন বিষন্ন প্রকৃতির এক শিশু। বন্ধুবান্ধব হীন। অবসরের সবটুকু সময় পার করতেন কমিক বই ও সাজগোজের ম্যাগাজিন পড়ে এবং মায়ের তৈরি কুকি খেয়ে। হাইস্কুল অতিক্রম করার পর নিজের শহরে একটা পোস্টঅফিসে কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন কিছুদিন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তা ছেড়ে দেন। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, শুধুমাত্র উপন্যাস লেখার জন্যেই স্রষ্টা তাকে পার্থিব জগতে প্রেরণ করেছেন। সুতরাং এটাই তার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।

১৯৩০ সাল। এই বছরে তার জীবনে লেখা ৫ম গল্পটি ছাপা হয়েছিলো। Weird Tales নামক ম্যাগাজিনে। বিনিময়ে তিনি ২০ ডলার পেয়েছিলেন। পরবর্তী বছরে তিনি প্রতিমাসে ন্যূনতম ৭০,০০০ শব্দের লেখা লিখতেন। তারও পরের বছরে এটাকে তিনি উন্নীত করেছিলেন ১,০০,০০০ শব্দে। মৃত্যুর পূর্ববর্তী বছরে তা পৌছেছিল ১,৫০,০০০ শব্দে। প্রচলিত আছে যে, প্রতি ছয়মাসে তাকে একটা করে নতুন Remington টাইপরাইটার কিনতে হত।

হার্টফিল্ডের প্রতিটা লেখার বিষয়বস্তুই ছিলো হয় এডভেঞ্চার, নয় ভয়াল গল্প। তার সবচেয়ে হিট করা লেখা একটা সিরিজ রচনার নাম Waldo, Boy Adventurer। এটা ছিলো এডভেঞ্চার ও ভয়াল গল্পের আনন্দিত সংমিশ্রণ। সর্বমোট ৮০টি ভলিউম লিখেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এই লেখাগুলোতে নায়ক Waldo ৩ বার মৃত্যুবরণ করে, ৫০০০ শত্রুকে নিধন করে, এবং মোট ৩৭৫ জন নারীর সঙ্গে সহবাস করে। এদের মধ্যে একজন নারী ছিল মঙ্গল গ্রহের। জাপানী অনুবাদে Waldoর অনেকগুলো গল্পই পাঠ করা সম্ভব।

হার্টফিল্ড অপছন্দ করতেন অনেক বিষয়ই। যেমন, পোস্টঅফিস, হাইস্কুল, প্রকাশনা সংস্থা, গাজর, নারী, কুকুর ইত্যাদি। তালিকা করতে গেলে অসীম হয়ে যাবে। Paramount Pictures ও FBI Testing Centre ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে সবচেয়ে বেশী অস্ত্রের (Gun) মালিক ছিলেন তিনি। একমাত্র যে অস্ত্রগুলি তিনি জোগাড় করতে পারেননি, সেগুলো ছিলো Anti–aircraft Gun এবং Anti-tank Weapon। তার সবচেয়ে পছন্দের অস্ত্র ছিলো একটা .৩৮ রিভলভার। মুক্তো দিয়ে সজ্জিত ছিল এটার হাতল। চেম্বারে তিনি শুধুমাত্র একটা বুলেট রাখতেন এবং গর্ব করে বলতেন, “এই শিশুকে(Baby) আমি একদিন ব্যবহার করব। নিজেকে মীমাংসা করার জন্যে।”

এতদসত্ত্বেও ১৯৩৮ সনে যখন তার মা মৃত্যুবরণ করলেন, তিনি বিশাল যাত্রাপথ অতিক্রম করে নিউইয়র্কে পৌঁছেছিলেন, শুধুমাত্র Empire State Building এর ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সামনের পেভমেন্টের ওপরে পড়ে ব্যাঙচ্যাপ্টা হয়ে মৃত্যুবরণ করার জন্যে। তার ইচ্ছানুসারে দার্শনিক নিৎসের (Nietzsche) একটা উদ্ধৃতি তার সমাধিপাথরের ওপরে খাঁজ কেটে লেখা হয়: ‘দিনের আলোয় যারা বাস করে তারা কীভাবে রাত্রির গভীরতা উপলব্ধি করবে?’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়