ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সরকারি ব্যয়ে লাগাম শুরু, সাশ্রয় অর্ধলক্ষ কোটি টাকা

বাণিজ্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২৪, ৪ জুলাই ২০২২  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় বড় ধরনের কৃচ্ছ্র সাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ৫০ প্রকল্পে (সি-ক্যাটাগরি) অর্থ ছাড় স্থগিত করেছে অর্থ বিভাগ।

আর বি-ক্যাটাগরির প্রায় ৫০০ প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ অর্থ ছাড় স্থগিত করা হয়। এছাড়া মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় সব ধরনের মোটরযান ও জলযান কেনাকাটায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ, আপ্যায়ন ও ভ্রমণ ব্যয়সহ মনিহারি, কম্পিউটার-আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় ৫০ শতাংশ ব্যয় করতে বলা হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ ব্যয় করা যাবে না।

এছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানি ব্যয়ও পুরোপুরি স্থগিত করা হয়। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে সম্ভাব্য সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয় হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছর শুরুর তৃতীয় দিনের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নিল অর্থ মন্ত্রণালয়।

গতকাল রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও উন্নয়ন বাজেটের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’

বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে অর্থ ব্যয়ে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়। 

গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের বক্তব্যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় তথা অপচয় কমাতে হবে। সব বিলাস দ্রব্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় মনোযোগ দিতে হবে। 

বিগত দুই বছরে অপ্রত্যাশিত করোনার অভিঘাত কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সময় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসাবে দেখা দেয় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। ২৪ ফেব্রুয়ারি এই যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়ে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১১৩ মার্কিন ডলারে উঠে। অপরদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ১২ গুণ বৃদ্ধি পায়। তেল ও গ্যাসের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়।

কারণ ওইসব পণ্যের সরবাহকারী দেশ ইউক্রেন ও রাশিয়া। সারের মূল্য বৃদ্ধি পায় ১১৪ শতাংশ। পাশাপাশি সয়াবিনের মূল্য বেড়েছে ২৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৮২০ কোটি মার্কিন ডলার।

বেশি দামে পণ্য কিনে সাশ্রয় মূল্যে দিতে গিয়ে ভর্তুকির ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে গত বছরে ভর্তুকিতে সরকারের ব্যয় হয় ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, সেখানে চলতি অর্থবছরে ব্যয় হবে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কৃচ্ছ সাধনের দিকে মনোযোগ দিয়েছে সরকার।

সূত্রমতে, কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে কোন কোন খাতে কৃচ্ছ সাধন করা হবে সেটি শনাক্ত করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের চিন্তা করছে। এর আগের অর্থবছরে কৃচ্ছ সাধনের মাধ্যমে অর্থ বিভাগ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আপ্যায়ন ভ্রমণসহ অন্যান্য ব্যয় স্থগিত করেছে। কিন্তু কম্পিউটার ও মনিহারিসহ কিছু পণ্য প্রয়োজনীয়। এসব খাতে ব্যয় কমানো ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে।

স্বাভাবিক নিয়মে প্রকল্পের ব্যয় করতে পারে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। বছরের শেষ দিকে এসে সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করতে পারে। এখন অর্থবছর শুরু হয়েছে। এ উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে ব্যয় সাশ্রয়ের। তবে সরকারের এ উদ্যোগ সমর্থন করা যায়।

সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে যানবাহন কেনা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। কৃচ্ছ সাধনের আওতায় নতুন ও প্রতিস্থাপক হিসাবে সব ধরনের যানবাহন ক্রয় বন্ধ করা হয়েছে। ফলে এ খাতে সরকারের সাশ্রয় হবে পুরো অর্থই।

এছাড়া ভ্রমণ ব্যয় বাবদ নতুন বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। এর অর্ধেক ব্যয় স্থগিত করা হয়। অর্থাৎ এ খাতে ব্যয় করা যাবে না ১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা।

মুদ্রণ ও মনিহারি খাতে ২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া আছে। অর্থ বিভাগের নির্দেশ মোতাবেক এ টাকার অর্ধেক ব্যয় করা যাবে। অর্থাৎ ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা অর্থ ছাড় স্থগিত হয়েছে।

এ বছর কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কেনা বাবদ ২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা স্থগিত করা হয়। এ খাতেও মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ খরচ করতে পারবে না।

নতুন অর্থবছরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনাকাটায় ব্যয় করার কথা ১৫ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৫০ শতাংশ ব্যয় স্থগিত করার ফলে ৭ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ব্যয় করা যাবে। বাকি অর্থ ব্যয় স্থগিত থাকবে। 

এছাড়া বর্তমান করোনার চতুর্থ ঢেউ চলছে। যে কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ ব্যয়ে ৫০ শতাংশ স্থগিত করা হয়েছে।

এ খাতে ৪ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও অর্থ বিভাগের এ আদেশের পর ব্যয় করতে পারবে ২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।

বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা, মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচিতে আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ ৫ হাজার ১৩ কোটি টাকাও স্থগিত করা হয়।

এদিকে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বড় ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করা হবে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।

এডিপিভুক্ত ১৩শ প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্পকে গুরুত্ব অনুসারে এ, বি ও সি ক্যাটাগরি ভুক্ত করা হয়েছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে ক্যাটাগরি ‘এ’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, দপ্তর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চিহ্নিত এ ক্যাটাগরি প্রকল্পগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া মধ্যম আয়ের প্রকল্পগুলোকে ক্যাটাগরি বি-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ৫০০টি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয় এসব প্রকল্পে সরকারি অংশের (জিওবি) ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখতে হবে।

অবশিষ্ট অনূর্ধ্ব ৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা যাবে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতাধিক প্রকল্প সি-ক্যাটাগরিতে আনা হয়েছে। এসব প্রকল্পে পুরোপুরি অর্থ ছাড় স্থগিত করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সীমিত সম্পদ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রকল্প ঘিরে কৃচ্ছ সাধন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সাশ্রয়কৃত অর্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে। যাতে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়।

এদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানি ভাতাও স্থগিত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি), প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি), বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিপিইসি), বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (এসপিইসি) এবং বিভাগীয় বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (ডিএসপিইসি)।

ব্যবসা বাণিজ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়