ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বান্দরবানে ৫ মাসের অভিযানে ৫৫ জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:১২, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

বান্দরবানে ৫ মাসের অভিযানে ৫৫ জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার

বান্দরবানে ৫ মাসের অভিযানে ৫৫ জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার

২০২২ সালের ৩ অক্টোবর থেকে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় অভিযান চালাচ্ছে র‍্যাব সদর দপ্তরের একটি বিশেষ টিম। এ অভিযানে র‍্যাবের কয়েকটি ব্যাটালিয়নও অংশ নেয়। এছাড়া অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে এ পর্যন্ত পাহাড় ও সমতল থেকে ৫৫ জন জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শুধু বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা থেকে জঙ্গি সংগঠনের ৩১ সদস্য এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফের ১৭ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আরও ২৮ জনকে খুঁজছে র‌্যাব।

সর্বশেষ গতকাল বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বান্দরবান র‌্যাব কার্যালয়ে আরও ১৭ জঙ্গি ও ৩ জন কেএনএফ সদস্যকে হাজির করা হয়। এর আগে গত মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) রুমা-থানচি সীমান্তের বাকলাই ২৭ কিলোমিটার এলাকায় সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে র‌্যাবের গুলি বিনিময়ের পর হয়। পরে ওই এলাকা থেকে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ১৭ জন ও কেএনএফের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে কেএনএফ প্রধান নাথাম বম এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত ফ্লাগ ক্রসও রয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গতকাল বুধবার সকালে বান্দরবান র‌্যাব কার্যালয় সংলগ্ন জেলা পরিষদের হলরুমে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তিনি। 

আটকরা হলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ারর সদস্য কুমিল্লা সদরের মো. আস সামী রহমান সাদ (১৯), বরগুনার বেতাগী এলাকার মো. সোহেল মোল্লা সাইফুল্লাহ (২২), পটুয়াখালী সদরের মো. আল আমিন ফকির মোস্তাক (১৯), কুমিল্লার লাঙ্গলকোট এলাকার মো. জহিরুল ইসলাম ওরফে ওমর ফারুক (২৭), পটুয়াখালী সদরের মো. মিরাজ হোসেন ওরফে দোলন, মুন্সীগঞ্জের টংগিবাড়ীর রিয়াজ শেখ জায়েদ (২৪), পটুয়াখালীর মহিপুরের মো. ওবাইদুল্লাহ (২০), পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের জুয়েল মাহমুদ (২৭), টাঙ্গাইলের ধানবাড়ীর মো. ইলিয়াছ রহমান (৩২), ঝালকাঠি সদরের মো. হাবিবুর রহমান (২৩), কুমিল্লা সদরের মো. সাখাওয়াত হোসেইন (২১), বরিশালের কোতোয়ালির মো. আব্দুস সালাম রাকি (২৮), কুমিল্লার লাকসামের যোবায়ের আহমদ (২৯), পটুয়াখালীর মো. শামীম হোসেন (২৬), হবিগঞ্জের তাওয়াবুর রহমান সোহান (২০), বরিশালের মাহমুদ ডাকুয়া (২০), মাগুরার মোহাম্মদ আবু হুরাইরা (২২) এবং পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের সদস্য লাল মোল সিয়াম বম, ফ্লাগ ক্রস, রাঙ্গামা‌টি বিলাইছ‌ড়ির মালসম পাংকুয়া (৫২)।

গত মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকে রুমা উপজেলার রেমাক্রি-প্রাংশা ইউনিয়নের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যবর্তী ধুলীচান ম্রো পাড়া এলাকায় র‌্যাবের এই অভিযানে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি, উগ্রবাদী বই, কন্টেন, লিফলেট, এবং নগদ ৭ লাখ টাকা। 

র‌্যাব জানায়, গত পাঁচ মাসের ধারাবাহিক অভিযানে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'র ৩৮ এবং পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) বা বম পার্টির ১৪ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব জানায়, বান্দরবানে কেএনএফ এর অন্তত ২ শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে। তবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সব আস্তানা ইতিমধ্যে র‌্যাব গুড়িয়ে দিয়েছে। 

কেএনএফ প্রধান নাথান বম এখন কোথায়, এ প্রশ্নের উত্তরে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া (জামাতুল আনসারের) সামরিক শাখার প্রধান রণবীরকে নাথান বম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। রণবীরের বক্তব্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর থেকে নাথান বমের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। নাথান বম বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছে তার কোনো তথ্য নেই তাদের। 

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পুরো অভিযানটি র‍্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা পরিচালনা করেছে। এ সময় সহযোগিতা করেছে র‍্যাব-৭। তথাকথিত হিজরতের নামে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়া ৫৫ জনের নামের তালিকা তৈরি করেছি আমরা। গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জন ওই ৫৫ জনের তালিকের মধ্যে রয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এই ১৭ জনসহ এপর্যন্ত ২৩ জনকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি আমরা। ২ জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ২ জনকে। এ নিয়ে সর্বমোট ২৭ জনের তথ্য আমরা আমরা। আরো ২৮ জন পলাতক রয়েছে তাদের খুঁজছে র‍্যাব।’ 

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এ পর্যন্ত প্রথম দফায় ৫ জন, দ্বিতীয় দফায় ১০ জন, তৃতীয় দফায় ২ জনসহ মোট ১৭ জন জঙ্গি এবং তিন দফায় ১৭ জন কেএনএফ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠনে যুক্ত থাকা আমাদের করা তালিকায় ৫৫ জনের মধ্যে ২৭ জনকে আমরা আইনের আওতায় আন‌তে সক্ষম হয়েছি। তারা অর্থের বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতায় পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।’ 

তি‌নি আরও বলেন, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আরও ২৮ জনকে গ্রেপ্তারে র‍্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। 

শিক্ষার্থীরা জঙ্গি সংগঠনে যেভাবে যুক্ত হলো :
গ্রেপ্তারকৃত আস সামী কুমিল্লার একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক এ অধ্যয়নরত ছিল। তিনি ২০২১ সালে কুবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহ'র মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করেন। জুয়েল স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে রাজধানী ঢাকায় জুতার ব্যবসা করতেন। ২০১৮ সালে তিনি সিরাজের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করেন। 

সোহেল মোল্লা রাজধানীর কলেজে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এ অধ্যয়নকালীন সময়ে জুয়েল মাহমুদ (গ্রেপ্তার) এর মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করেন। তিনি রাজধানী শহরে উচ্চতা এবং ওজন মেপে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েন। আল আমিন পটুয়াখালীর পলিটেকনিকেল কলেজে অধ্যয়ণরত ছিলেন। ২০২২ সালে পটুয়াখালীর নেছারউদ্দিন এর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করেন। মিরাজ শিকদার রাজধানীর কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে। ২০২০ সালের শেষের দিকে পটুয়াখালীর সিরাজের মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করে। রিয়াজ ২০১৯ সালে রাজধানীর কলেজে অধ্যয়নরত ছিল। পাশাপাশি সে রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন। ২০২১ সালের শেষের দিকে তার বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করেন। ওবায়দুল্লাহ কুতুবখালীর একটি মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত ছিলেন। তিনি পটুয়াখালী সিরাজের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করেন। পরবর্তীতে আস সামী, জুয়েল, সোহেল, আল আমিন, মিরাজ, রিয়াত এবং ওবায়দুল্লাহ গত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১২ জনের গ্রুপের সঙ্গে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে আসে।

গ্রেপ্তারকৃত আব্দুস সালাম মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতেন। তিনি সংগঠনের শূরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করেন। যোবায়ের ২০১৪ সালে কুমিল্লার মাদ্রাসা থেকে পড়ালেখা সম্পন্ন করেন। তিনি লাকসাম থানায় মসজিদের ইমামতি করতেন। লাকসামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনের আমীর মাহমুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং সংগঠনে যোগদান করেন। শামীম মাদ্রাসা হতে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৯ সালের শেষের দিকে পটুয়াখালীর গ্রেপ্তারকৃত উমায়ের এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করেন। তাওয়াবুর রহমান সিলেটের কলেজে স্নাতকে অধ্যয়নরত ছিল। সামরিক শাখার প্রধান রণবীর এর মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করে। আবু হুরাইরা স্থানীয় একটি মাদ্রাসার অধ্যয়নরত ছিল। সে ২০২১ সালের প্রথম দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের সাথে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে রাকিবের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করে এবং ২০২১ সালের মাঝামাঝিতে হিজরতের উদ্দেশ্যে জিহাদের জন্য কুমিল্লা যায়। ইলিয়াস ২০১৬ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ছিল। প্রবাসে থাকাকালীন এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনের আমীর মাহমুদের সাথে তার পরিচয় হয় এবং প্রবাসে থাকা অবস্থায় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে সে দেশে ফিরে আসে। পরবর্তীতে হাসান আব্দুস সালাম, যোবায়ের, শামীম, মামুন, তাওয়ার, আবু হুরাইরা এবং ইলিয়াস ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ১৫ জনের একটি গ্রুপের সঙ্গে বান্দরবানের পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য আসে।

গ্রেপ্তারকৃত জহিরুল ইসলাম ২০১৯ সালে বিবিএ পাস করেন। সংগঠনের নারায়ণগঞ্জের এক সদস্যের মাধ্যমে তিনি এই সংগঠনে যোগদান করে এবং ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা থেকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে গমন করেস। মাহমুদ ডাকুয়া অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়ণরত ছিল। তিনি নীলক্ষেতে একটি বইয়ের দোকানে কাজ করতেন। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে নীলক্ষেতে জনৈক এক শিক্ষার্থীর মাধ্যমে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের সঙ্গে তার পরিচসা হয় এবং তার মাধ্যমে তিনি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই করেন। হাবিবুর রহমান স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করেন। তার বরিশালে একটি লন্ড্রীর দোকান ছিল। ২০২০ সালে বরিশালের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগঠনে যোগদান করে। পরবর্তীতে মাহমুদ ডাকুয়া এবং হাবিবুর রহমান একটি গ্রুপের সঙ্গে ২০২১ সালের মার্চ মাসে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য গমন করেন। সাখাওয়াত হোসেইন কুমিল্লার স্থানীয় মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময় তার এক সহপাঠীর মাধ্যমে এই সংগঠনে যোগদান করে এবং ২০২২ সালে পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আসে।

কুমিল্লা ও ঢাকার সাত কলেজছাত্র গত ২৩ আগস্ট বাসা থেকে বেরিয়ে আর না ফেরায় থানায় জিডি করেছিল পরিবার। পরে ঢাকার এক তরুণ ১ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফিরে আসেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া'র আত্মপ্রকাশের কথা জানতে পারে র‌্যাব।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়