ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাঙালির শেকড়ের স্বরূপ: ফোকলোর

শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২ জুন ২০২২  

সংগৃহীত

সংগৃহীত

বাঙালি একক কোনো নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। মূলত একে শংকর জাতিরূপে অভিহিত করা হয়েছে। এই শংকরায়ণের পেছনে লুকিয়ে আছে নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রথম যে জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে, তারা নিগ্রোয়েড বা অস্ট্রালয়েড শ্রেণির অন্তর্গত। কালের পরিক্রমায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রাবিড়, কোল, মুণ্ডা, মঙ্গোলয়েড, আলপিয়ান, নার্ভিক, আরব জাতি প্রভৃতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ শতকের আগেই বাংলায় আর্যদের আগমন ঘটে। এরপরও মিশ্রণ অব্যাহত থাকে। অনেক জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গঠিত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুসলিম অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত এর মূল কাঠামো সৃষ্টির কাল। ফলে রক্তের স্রোতধারায় মিশে আছে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলেই যে রূপ চোখের সামনে চির উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেগুলোই মূলত ফোকলোরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদান। কালের ধারাবাহিকতায় বিন্দু-বিন্দু জল জমে তা সিন্ধুর সৃষ্টি করেছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান নাগরিক জীবন থেকে বহুকাল আগে সেই অতীতের চিন্তা-ভাবনা ফোকলোরে স্থান পেয়ে বিচিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক যুগে এসে উপনীত হয়েছে। এর সঙ্গে অতীত জীবনের রূপটিও বহন করে এনেছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতি জীবনাচরণ বদলে গেলেও শেকড় থেকে তা লুপ্ত হয়ে যায়নি। জীবনের বিচিত্র ধ্যান-ধারণাকে ঘিরেই এর ডালপালা গজিয়েছে। ক্রমাগত পরিবর্তন ও পুনরাবৃত্তির ভেতর দিয়ে তা পরিণামে একটা সামগ্রিক রূপ লাভ করেছে। যাকে আমরা একত্রে ফোকলোর (Folklore) নামে অভিহিত করছি।

Folklore শব্দটি মূলত ‘Folk’ এবং ‘lore’ এই দুটির সমন্বয়। ফোক শব্দের অর্থ লোক। যারা মূলত একই ভৌগোলিক পরিসীমায় অবস্থান করে। ভাষা ও সংস্কৃতি একই। অন্যদিকে ‘লোর’ শব্দকে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় লোক সম্পর্কিত জ্ঞান, বিদ্যা, পাণ্ডিত্য, মতবাদ, জাতিগত ঐতিহ্য, প্রথাগত বিদ্যা প্রভৃতি। ইংরেজিতে Folklore শব্দটি যে ব্যাপক অর্থে গৃহীত হয়েছে, বাংলায় তাকে লোকসাহিত্য বললে পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায় না। এই Folklore-এর প্রতিশব্দ হিসেবে বিভিন্ন গবেষকগণ লোকবিজ্ঞান, লোকশ্রুতি, লোকলোর ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ নাম ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে লোকসাহিত্য নামটাই প্রাধান্য পেয়েছে। যার কল্যাণে লোকসাহিত্য বা ফোকলোর শব্দটি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে তিনি হলেন William Jhon Thoms. ১৮৪৬ সালের ২২ আগস্ট ‘The Athenaeum’ পত্রিকায় লিখিত একটি পত্রে শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে নানা পণ্ডিত এবং প্রতিষ্ঠানের চেষ্টায় বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসাহিত্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘লোকসাহিত্য আমরা যে রূপে লোকমুখ হইতে সংগ্রহ করিয়া থাকি, তাহা সমষ্টিরই সৃষ্টি, ব্যষ্টির সৃষ্টি নহে। লোকসাহিত্যের এই অংশই সাহিত্য সংজ্ঞালাভের অধিকারী। ব্যক্তিবিশেষের মনে যে ভাবটির উদয় হয়, তাহার প্রকাশ অপরিণত ও অপরিস্ফুট থাকিবার কথা, ইহা দশজনের হাতে পড়িয়াই প্রকৃত সাহিত্যের রূপ লাভ করিয়া থাকে। অতএব ব্যষ্টির মনে যে সকল অপরিণত ভাবের উদয় হয়, তাহাই সমষ্টি লোকসাহিত্যের রূপে সমাজকে পরিবেশন করে। অতএব লোকসাহিত্যের বহিরঙ্গগত পরিচয়ের জন্য সমষ্টির দান স্বীকার করিয়া লইলেও, ইহার অন্তর্নিহিত ভাব-মূলে যে ব্যষ্টির প্রেরণাই কার্যকরী হইয়া থাকে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। অতএব, লোক-সাহিত্য ব্যষ্টি ও সমবেত সৃষ্টি; ব্যষ্টির মনে যে ভাবের উদয় হয়, তাহার অসম্পূর্ণ রূপায়ণকেই সমষ্টি নিজের আদর্শে সম্পূর্ণ করিয়া লয়।’১           

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Alan Dundes বলেছেন, ‘Floklore as a mirror of culture frequentlz reveals the areas of special concern. It is for this reason that analzses of collections of folklore can provide the individual who takes advantage of the opportunities afforded bz the studz of floklore a waz of seeing another culture from the inside out instead of from the outside in the usual position of a social scientist or teacher...’২

ড. মযহারুল ইসলাম এ সম্পর্কে বলেন, ‘ফোক তারাই যারা সুদূর অতীত অর্থাৎ আদিম কাল থেকে ফোকলোর সৃষ্টি করে এসেছে এবং এখনো সৃষ্টি করে চলেছে। লোক কোনো নির্দিষ্ট স্তরের মানুষ নয়, সমাজের যে কোনো স্তরে লোক বাস করতে পারে (...) শহরে, নগরে, গ্রামে সে থাকতে পারে। ফোক যেমন একটি জনগোষ্ঠী হতে পারে, একটি বিশেষ সমাজবদ্ধ শ্রেণি হতে পারে, একটি বিশেষ ভাষার ও সংস্কৃতির বলয়ে আবদ্ধ সমাজ হতে পারে, তেমনি হতে পারে একটি দল বা গ্রুপ।’৩

ইংরেজি ডিকশনারি অনুযায়ী ফোকলোর অর্থ লোকচারবিদ্যা। সেহেতু ফোকলোরের কাজ মানুষ, সমাজ-সংস্কৃতি। ফলে এটিকে সমাজবিজ্ঞানের একটি অন্যতম অংশ হিসেবেও ধরা হয়। ফোকলোর মূলত সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সাহিত্যকে বোঝায় যা বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে ছড়িয়ে পড়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায়। লোকসাহিত্যের প্রধান ধর্মই এটা চির সজীব। ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমেই এটি অগ্রসর হয় এবং মৌখিক আবৃত্তি ও পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এটির জীবনী শক্তি রক্ষা পায়। মানবজীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, ইতিহাস, ঐতিহ্য জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ধ্যান-ধারণা এখানে স্থান পেয়েছে নানা রূপে। 

দুই.
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট অংশজুড়ে আছে লোকসাহিত্য বা ফোকলোর। সাধারণ কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর অলিখিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য। পূর্ববর্তীকালে অশিক্ষিত সমাজের লোক দ্বারা সৃষ্ট কোনো সাহিত্যই লিখে রাখা হয়নি। স্মৃতি ও শ্রুতিতে এ সাহিত্যগুলো এক যুগ থেকে আরেক যুগে পাড়ি জমিয়েছে ফলে তা অনেকটা কল্পনা পরম্পরায় পরিবর্তিত হয়েছে। ফোকলোরের যে অংশগুলো লোকসমাজে বেঁচে আছে তা মূলত এক চিরন্তন মানবিক বৃত্তির ওপর নির্ভর করে রচিত হয়েছে। সেইজন্য এগুলো দেশ কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি হয়েছে, সে অনুযায়ী ফোকলোরকে প্রাথমিকভাবে ৪ ভাগ করা যায়। যথা-
★ লোকসাহিত্য
★ লোকসংস্কৃতি
★ লোকশিল্প এবং            
★ লোকবিজ্ঞান।

মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য। কবি-সাহিত্যিকগণ তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির জন্য লোকসাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। এমনকি অনুবাদ সাহিত্যের ওপরও লোকসাহিত্যের প্রভাব বিদ্যমান। মধ্যযুগের কবিরা আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি লোকসাহিত্য থেকেও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন প্রতিনিয়ত। লোকসাহিত্য গড়ে উঠেছে প্রাচীন বিভিন্ন কাহিনি বা আখ্যানকে কেন্দ্র করে। রাধা-কৃষ্ণ, দ্রৌপদী-অর্জুন, রাম-সীতা, বেহুলা-লখিন্দর, পরীর কাহিনি, ঈশপের কাহিনি প্রভৃতির মিশ্রণে রূপ লাভ করেছে ফোকলোরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ লোকসাহিত্য। মাটির সঙ্গে ফোকলোরের সংযোগ নিবিড়। সাধারণ জনগণের স্মৃতি এবং শ্রুতির মাধ্যমে কালের পরিক্রমায় এসব সাহিত্য মানব সমাজে স্থান লাভ করেছে। লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ নিদর্শন বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে- ধাঁধা, ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, লোককাহিনি, লোকগান, লোকগীতিকা, কথা প্রভৃতি। লোকসাহিত্যের সব শাখা-প্রশাখায় লেগে আছে বাঙালির আবহমান ইতিহাস-ঐতিহ্য। বাঙলা ও বাঙালির শেকড়ের সন্ধান করতে তাই বার বার আমাদের ফোকলোরের কাছে যেতে হয়। আমাদের হৃদয়ের খোরাক জোগায় এসব উপাদান।

ফোকলোরকে চিনতে বা জানতে হলে এর সব শাখার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো দরকার। ফোকলোরের সবচেয়ে প্রাচীনতম ও বিশেষ অংশ ছড়া। এই শাখার সঙ্গে সবারই পরিচয় রয়েছে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হওয়ার পরই শিশুর জীবনাচরণে ফোকলোরের নানান উপাদান জড়িয়ে পড়ে ক্ষেত্র বিশেষে। শিশুকে ঘুম পাড়াতে, আনন্দ দানে, মানুষের কু-নজর থেকে বাঁচাতে, শিশুর দুষ্টামি রুখতে মায়েরা ফোকলরের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ছড়া লোকসাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীনতম শাখা। মানব জীবনের সর্বস্তরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত যা মৌখিক আবৃত্তি করা হয়, তাই ছড়া। তবে গান ও ছড়ার মধ্যে যে পার্থক্য তা সুর, তাল, ছন্দ এবং লয়ের। ছড়ার সুর বৈচিত্র্যহীন কিন্তু গানের সুর বৈচিত্র্যময়। ছড়া সম্পর্কে আশুতোষ ভট্টাচার্য তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মৌখিক আবৃত্তির জন্য মুখে মুখেই যাহা রচিত হয় তাহাই ছড়া। মৌখিক ঐতিহ্য হইতেই ছড়াটি রচিত হইয়াছে, তাহার একটি প্রধান প্রমাণ এই যে, ইহারই একটি রূপ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঁকুড়া জিলার লোক-মুখ হইতে সংগৃহীত হইয়াছে।’৪

ছড়াগুলোকে কাজের প্রকৃতি ও ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। ছেলে খেলার ছড়া, ছেলে ভোলানো ছড়া, ঘুম পাড়ানি ছড়া, মেয়েলি ছড়া, নৈসর্গিক ছড়া, নীতিমূলক ছড়া, ঐন্দ্রজালিক ছড়া প্রভৃতি। ছড়ার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আজন্ম লালিত স্মৃতি। মাটির মৃদু গন্ধে যেমন মাতৃভূমির ছোঁয়া লেগে থাকে ঠিক, তেমনি ছড়াগুলোর সঙ্গে মিশে আছে জীবনের সুখস্মৃতি। বড় কিংবা ছোট; সবার কাছেই এগুলো সুখপাঠ্য। শিশুকে ঘুম পাড়াতে নানি-দাদি, মায়েরা গুন গুন করে ছড়া আবৃত্তি করে থাকে। পরবর্তীকালে একটা সময় শিশুর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে মিশে যায় ছড়াগুলো। তখন শিশুকে ছড়া বলে বলেই ঘুম পাড়াতে হয়। শিশুর ঘুমের সঙ্গে গীত ছড়াগুলোকে প্রকৃতপক্ষে ছেলে ভোলানো ছড়া নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার লোকসাহিত্য-ছড়া’ গ্রন্থে এমন অসংখ্য ছড়ার রূপভেদ তুলে ধরেছেন। একই ছড়া অঞ্চল ভেদে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। রাজশাহী অঞ্চলে যে ছড়াগুলো গৃহীত হয়েছে তাদের আঞ্চলিক ভাষা বা ঐতিহ্যে সেগুলোই পাবনা, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে ভিন্ন।

শিশুর ঘুম বাঙালি মায়েদের কাজকে সহজ করে তোলে। গ্রামবাংলার আবহমান মায়েরা সন্তানকে কোলে-পিঠে করে গড়ে তোলে। তাদের একাধিক কাজের মাঝে একটুও ফুরসত নেই নিজের সন্তানকে বাড়তি সময় দেওয়ার। তবু শিশুকে বুকে আগলে রাখে পরম মমতায়। শিশুর একটু ঘুম তাই মায়ের কাছে পরম পাওয়া। শিশুকে দুই হাঁটুর ওপর নিয়ে এমনকি বুকে নিয়ে মায়েরা তাকে দোলাতে দোলাতে ঘুম পাড়ান। আবার শিশুর খাওয়ানোটা অধিক কষ্টের। সেক্ষেত্রেও মায়েরা তাকে বিশেষ মন্ত্রে মুগ্ধ করেন ছড়ার মাধ্যমে। মায়ের কণ্ঠস্বরের ভেতরে শিশু নিজের কণ্ঠের স্বর শুনতে পায়। এজন্য মাতৃকণ্ঠের আবৃত্তি তাকে আনন্দ দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছেলে-ভুলানো’ ছড়ার আলোচনায় বিস্তৃত ছড়া সাহিত্যের একটি রূপ তুলে ধরেছেন। যা থেকে এর সমগ্র পরিচয় ফুটে ওঠে। অতএব বাংলার লোকসাহিত্যে ছড়া বিশেষভাবে উল্লখযোগ্য। বাঙালি জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা বিরাজমান। রাজশাহী অঞ্চলে ছেলে ভুলানোর ছড়াটি আবৃত্তি করা হয় এভাবে,               
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো      
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে 
খাজনা দেবে কিসে!        
ধান ফুরাল পান ফুরাল  
খাজনার উপায় কি?       
আর কিছুকাল সবুর করো            
রসুন বুনেছি।৫ 

একই ছড়াটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবৃত্তি করা হয় ভিন্ন পন্থায়। ‘মণি ঘুমাইল পাড়া জুড়াইল ‘গরকী’ আইলো দ্যাশে গুলগুলিয়ে ধান খাইয়াছে খাজনা দিবে কিসে।’৬ অঞ্চল ও ভাষার পরিবর্তনে ছড়াগুলোরও বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়। বাঁকুড়া জেলার বেলেতোড় গ্রাম থেকে ১৩০২ সালে ছড়াটি সংগ্রহ করা হয়। বর্গীর হামলা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মারাঠা সাম্রাজ্য কর্তৃক (১৭৪২-১৭৫১) সাল পর্যন্ত দীর্ঘ নয় বছরব্যাপী বাংলাকে বারবার আক্রমণ করা হয়। এই মারাঠা আক্রমণই বাংলায় বর্গী হামলা নামে পরিচিত। জনশ্রুতিতে এই ছড়াটি এখনো জীবন্ত কিন্তু কালের পরিক্রমায় কিছু সংযোজন বা বিয়োজন হয়েছে। বাঙালি জাতির যে ইতিহাস তার সঙ্গে ফোকলোরের সম্পর্ক নিবিড়। ফোকলোরকে কাটাছেঁড়া করলেই বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাক্ষাৎ মেলে। বর্গী শব্দটি কালের পরিক্রমায় ‘গরকী’তে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু এর শেকড় সন্ধান করলে ইতিহাসের বর্গীকেই পাওয়া যায়।

তিন.
ধাঁধা লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর সংগ্রহ যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাংলার লোকসাহিত্য পঞ্চম খণ্ড-ধাঁধা’ গ্রন্থের নিবেদন অংশে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে ধাঁধা সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়। এ যাবৎ ইহার সংগ্রহ ও যেমন অকিঞ্চিকর হইয়াছে, তেমনি ইহার বিষয়ে কাব্য-কিম্বা সমাজবিজ্ঞান সম্মত আলোচনাও কিছুই হয় নাই। ইহার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুই উল্লেখ করেন নাই। ছড়া, গান এবং কথা সম্পর্কে তাঁহার যে গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা প্রকাশ পাইয়াছে, ইহার সম্পর্কে ও যদি তাহা প্রকাশ পাইত, তবে তাহা দ্বারা বাঙালী সংগ্রহক এবং সমালোচক অনুপ্রাণিত হইতে পারিতেন, কিন্তু তাহা হয় নাই বলিয়াই, ইহার প্রতি বিদগ্ধ সামাজের দৃষ্টি যথাযথ আকৃষ্ট হইতে পারে নাই।’৭ ধাঁধার মাধ্যমে জ্ঞান বুদ্ধিচর্চা হয়ে থাকে। প্রশ্নকর্তা নিজে উত্তর গোপন রেখে প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। ফলে বিপরীতপক্ষ যদি সঠিক উত্তর দিতে পারে, তাহলে তাকে জ্ঞানী ধরা হয়। না পারলে বোকা ভাবা হয়। ধাঁধার উত্তর জনশ্রুতিমূলক। আগে থেকে যদি ধাঁধাগুলোর সঙ্গে পরিচয় না থাকে, তবে এর উত্তর দেওয়া অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। লোকমুখে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। ধাঁধার মূলত দুটিরূপ সমাজে বিদ্যমান। প্রকৃতি ও গার্হস্থ্যবিষয়ক ভাবনার সঙ্গে কল্পনা এবং রসের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ব্যক্তির বুদ্ধি পরীক্ষার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে ছন্দের ব্যবহারও বিশেষভাবে চোখে পড়ে। এ কারণে অনেকেই ধাঁধা থেকে রূপক অলংকারের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করেন। তবে এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত, সে বিষয়ে ঢের মতপার্থক্য রয়েছে। পাশ্চাত্য সমাজে ধাঁধার শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে Riddle শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ উপদেশ দেওয়া। তবে সংস্কৃত ভাষায় এর অর্থ প্রহেলিকা। ধাঁধা শব্দটি মূলত প্রহেলিকা বা হেয়ালী মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর উদ্দেশ্য আরও ব্যাপক। ধাঁধার সাহায্যে সমাজের প্রাচীনতর রূপটির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কিভাবে কোন পথে এতদূর পাড়ি জমিয়েছে, তা জানার উপায় নেই। এমনকি এ বিষয়ে অনুমানও সব সময় নির্ভুল হয় না। মননশীলতায় কিছুদূর অগ্রসর না হয়ে কেউ ধাঁধা রচনা করতে পারেনি। এখানে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের পাশাপাশি বুদ্ধি প্রয়োগ আবশ্যক। ফলে মানব সমাজে বুদ্ধির বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ধাঁধার যে রূপ বর্তমান সেখানে ধাঁধাগুলোতে সুপ্রাচীন কালের স্বাক্ষর সঠিকভাবে মুদ্রিত হয়নি। তবে এগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক কালের ভাষার রূপ পরিলক্ষিত হয়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গেই মানুষের প্রথম পরিচয় ঘটে। ফলে সংখ্যা গণনায় আজও মানুষ আঙুলের ব্যবহার করে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ধাঁধা প্রচলিত আছে। যা মানবসমাজের প্রচীনতম ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী রচনাকে স্মরণ করায়। প্রাচীনতর রূপের পরিবর্তন ঘটলেও শেকড়ের ধারা অনুসরণ করেই এ যুগের ধাঁধাগুলো রচিত হয়েছে। ফোকলোর বাঙালি জাতির শেকড়ের ধারা অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছে যদিও কালের পরিক্রমায় এর প্রকাশ ভাবনা ভিন্ন রূপে প্রকাশিত।

আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হওয়ার পূর্বে শিশুর আত্মার বিকাশ ঘটানোর জন্য এই ধারায় শিক্ষা দেওয়া হতো। এ শিক্ষা মুখে মুখেই প্রদান এবং গ্রহণ করতো শিশুরা। কিন্তু যেদিন থেকে লিখিত পাঠ্য-পুস্তক এলো; সেদিন থেকে এ ধারাটা লুপ্ত হতে শুরু করলো। লৌকিক ধারার পরিবর্তে তা সাহিত্যিক ধারায় আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু লৌকিক ধাঁধাগুলো এখন গ্রাম্য শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরক্ষর মানুষের মনে আনন্দ সঞ্চার করে। ধাঁধার সাহায্যে আদিম সমাজের মানুষ যে মননশীলতার চর্চা শুরু করেছিল, তা কালের বিবর্তনে হারাতে বসেছে। সভ্যতার প্রভাব ব্যক্তিজীবনে যতই জটিল হচ্ছে ধাঁধার প্রভাব ততটাই বিলুপ্ত হচ্ছে। একদিন বাবা-মায়ের জীবনে অবসর ছিল। তারা সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতো। তাদের জ্ঞানের বিকাশে এগুলো আনন্দদানের উত্তম সঙ্গী ছিল। কিন্তু শহরায়ন ও নগরায়নের ফলে ধীরে ধীরে প্রাচীন প্রথার ধারাবাহিকতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিবাহ অনুষ্ঠান, চৈত্র সংক্রান্তি, অনাবৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের জন্য, শস্যসম্পদ বৃদ্ধির জন্য, অন্তেষ্টিক্রিয়া প্রভৃতি উপলক্ষে আদিম সমাজে ধাঁধা জিজ্ঞাসা করার রীতি ছিল। বুদ্ধি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তাকে জ্ঞানী আর না পারলে তাকে নির্বোধ ভাবা হতো। মৌখিক এই প্রশ্ন ও উত্তর দানের মাধ্যমে সবার মধ্যে হাসি-তামাশার আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হতো। যা বাঙালি জাতির প্রাচীন জীবনাচরণের প্রতি দিক নির্দেশ করে। প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্র বাইবেল, বেদেও ধাঁধার প্রভাব বিদ্যমান। বৈদিক যুগ থেকেই সমাজে সাহিত্যিক ধাঁধাগুলোর প্রচলন ছিল। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে যে সব ধাঁধার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তা মূলত লৌকিক ধাঁধারই রূপান্তর। লৌকিক উপদান নিয়েই সাহিত্যিক ধাঁধা গড়ে উঠেছে। ফোকলোর সম্পর্কে জানতে গেলে বাঙালির আবহমান ইতিহাসকে জানা হয়ে যায়। ফোকলোরের উপদান বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি-ঐতিহ্যেরই অবিচ্ছেদ্য রূপ। সমাজে আজও প্রচলিত কিছু ধাঁধা নিম্মরূপ:

★ বন থেকে বেরুল টিয়ে              
   সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।    
   (আনারস) 

★ একটু খানি পুষ্কুনি কইয়ে ভুর ভুর করে               
    রাজা আইলে প্রজা আইলে তুইল্যা সেলাম করে।               
    (হুঁকা)                 

★ রাজার বাড়ির মেনা গাই মেনমেনাইয়া চায়      
    হাজার টাকার মরিচ খাইয়া আরো খাইতে চায়।
    (শিলনোড়া)

ধাঁধাগুলোর মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সমাজ, প্রকৃতির রূপ পরিলক্ষিত হয়। যা ফোকলোরকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ধাঁধার মতোই ফোকলোরের অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রবাদ-প্রবচন (Proverb)। এটি ফোকলোরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। প্রাচীনকাল থেকে সমাজের রীতি-নীতি, নৈতিকতা, জীবনাচরণ, সংস্কৃতি, কৃষি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবাদ-প্রবচনের সৃষ্টি। মানুষের দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার একটি সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয় আলোচ্য অংশে। প্রবাদে আছে জ্ঞান ও সত্য প্রচারের অপরিসীম প্রচেষ্টা। প্রবাদ ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি হলেও লোকপরম্পরায় তা স্থান করে নিয়েছে মানুষের মনে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বাঙালির জীবন ধারণের সঙ্গে এগুলো মিশে আছে ওতোপ্রোতভাবে। কথাপ্রসঙ্গে নিজের অজান্তেই এগুলোর ব্যবহার ঘটে থাকে। ‘সর্বদাই প্রবাদ যে সংক্ষিপ্ত বাক্য তাহা নহে, ইহা প্রধানত একাধিক কবিতার পদ এবং অনেক সময়ই ইহা খুব সংক্ষিপ্তও হয় না। চারটি এবং ততোধিক পদেও একটি প্রবাদ সম্পূর্ণ হইতে পারে। সুতারাং ইহা যেমন সর্বদা সংক্ষিপ্ত নহে, তেমনই কেবলমাত্র বাক্যও নহে, কদাচিৎ সংক্ষিপ্ত বাক্য হইতে পারে মাত্র। বিশেষত এই সংজ্ঞা দ্বারা ইহার বিষয় এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানিতে পারা যায় না। তারপর long experience কিংবা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথাও যে সর্বদা ইহার মধ্যে প্রকাশ পায়, তাহাও নহে। ‘বন পোড়ে সবাই দেখে, মন পোড়ে কেউ দেখে না।’ আগুনে যে পোড়ায় একবার দেখিলেই তাহার অভিজ্ঞতা হয়, মনও দগ্ধ হইতে পারে, তাহা ব্যক্তিগত জীবনের একক অভিজ্ঞতা দ্বারাই অনুভূত হয়। সুতরাং দীর্ঘ অভিজ্ঞতার এখানে আবশ্যক নাই। অনেক সময় প্রবাদ কোন বিশেষ শ্রেণীর মানুষের বিশেষ কোন আচরণের সমালোচনা মাত্র, অনেক সময় ইহার মধ্য দিয়া শ্রেণিবিশেষের প্রতি ব্যঙ্গের ভাব প্রকাশ পায়, এই ব্যঙ্গ শ্রেণীগত হইলেও তাহা সমাজ দ্বারা সমর্থিত।’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়