ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

বই আলোচনা: টেরাকোটায় আঁকা পৌরাণিক প্রেম

দুঃখানন্দ মণ্ডল

প্রকাশিত: ১৭:০০, ১৫ মার্চ ২০২৩  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

কবি তাহমিনা শিল্পীর টেরাকোটায় আঁকা পৌরাণিক প্রেম একটি কবিতার বই। মূলত এই নামটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বেশ সুন্দর গন্ধ। ‘টেরাকোটায় আঁকা পৌরাণিক প্রেম’ নামটি মনে করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে গ্রামবাংলার মন্দিরগুলো। এতো সুন্দর ভাবে টেরাকোটার কাজ করা আছে যেখানে দেবদেবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠে মন।

বইটির প্রথম কবিতা আমার মনে দাগ কাটল। কবিতার নাম পরম্পরার গল্প। সকাল হলে সন্ধ্যা হবে আমরা সবাই জানি। কিন্তু তার রূপ বা বর্ণনা কেমন হতে পারে! 

‘ধূপছায়া গোধূলি বেলায়;
দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভালোবাসা পেরিয়ে-
দূরে উড়ে যায় পাখি।’

ধরুন এমনিভাবে যদি বলি; প্রতিটি শব্দ আমাদের জীবনের সাথে মিলে আছে। যেমন করে কবি বলছেন ‘দেওয়ালের ওপারে মিশে আছে আকাশ’। শেষ লাইনে আর এক কথা;  ‘আলমারিতে সুগন্ধ ছড়ায় বাবার পাঞ্জাবি’। যদি প্রথম থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখা যায় যে; ভালোবাসার জন্য কতভাবে জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায়। পাতার পর পাতা ছুঁয়ে আছে এ জীবন কথা।

‘কৃষ্ণঠাকুর’ কবিতায় কবি লিখছেন- 

‘তুমি গান শোনাচ্ছ আর আমি ভিজছি…’ আপনি পড়তে পড়তে কি নাম দিবেন? প্রেম না অপ্রেম? আসলে প্রেম এমনি ফুলের গন্ধের মধ্যেও বিরাজ করে আর কেমনভাবে দিনকাল গড়িয়ে যায় তা বোঝা যায় না। আসলে একটি অদৃশ্য শক্তিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা। আর এই বেঁচে থাকার স্বরূপ হলো কবির এই কবিতাটি।

কবিতাগুলির নামকরণ বেশ শৈল্পিক সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে রচনা হয়েছে। যেমন ‘অতীতের কাছে নতজানু আমি’, ‘যৌবনবতী মেঘের অপেক্ষায়’, ‘রাতকুমারী’, ‘উনুন পোড়া কঙ্কাল’, ‘গেরুয়া চোখে অনন্ত কুয়াশা’, ‘উদাস দৃষ্টিতে  ভোরের মায়া’, ‘কঙ্কালতন্ত্রে হাড় ভাঙার শব্দ’, ‘স্তনের নির্যাস কিংবা আগুন সংক্রান্তি’, ‘আত্মার নিরব কথোপকথন’, ‘নিভে যায় জলের জীবন’, ‘মৃত্যুতোরণে সোনালি রোদ্দুর’, কিংবা  ‘মেহমান পাখির জীবন’ ইত্যাদি। বইটি ৭৬ টি কবিতার মলাট বন্দী। 

তাহমিনা শিল্পী একজন কবি। তিনি কবিতার মানুষ। আসল কথা হলো কবিতার মতোই তার কবিতা যাপন। তার কবিতার গভীরে লুকিয়ে আছে স্বপ্ন, লুকিয়ে আছে প্রেম, লুকিয়ে আছে বিশ্বাস। কবিতার মধ্যে ডুব দিতে গিয়ে কখন যে রাত্রি এগিয়েছে তা টের পাইনি। 

‘দীর্ঘ রাতের অপর পাশে
আমাদের অনেকখানি পথ
আমরা হেঁটে চলি একে অন্যের ছায়া হয়ে
আমাদের স্বপ্ন এক ছোট্ট পুকুর 
                  তাকে বিভক্ত করো না।’

আসলে কবির কবিতা যাপন এমনি। খুব সরল সহজ ভাষায় তার কবিতার কথা বা কবিতার লাইন।

‘ইশারা’ নামক একটি চার লাইনের কবিতা। সেখানে শেষের লাইনটির যে গভীরতা তারপর আর তিনটি লাইনকে পাঠকের মনে না রাখলেও চলবে। কি সুন্দরভাবে জীবনকে বর্ননা করেছেন। তিনি লিখেছেন - ‘আমরা মূলত মৃত্যুর জন্য বাঁচি।’ কত সহজ ভাষায় এই গভীর কথাটি তিনি লিখে ফেললেন। আসলে একেই বলে কবিতা যাপন।

কবিতার মধ্যে এগিয়ে যেতে যেতে চোখ ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। যে মেয়েটি কোলাহলকে বুকেকেটে রাখে তাকে আমি বলি সাহসী রাতকুমারী। সেই পারে মধ্যরাতে সিম্ফনি হয়ে বেঁচে থাকতে, সেই পারে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে। সেই পারে আত্মবলিদান দিতে। কিন্তু বাতাস ছাড়া কেউ জানতো না রক্ত গোলাপের ঘ্রাণ পাইনি। কবিতাটি একটি প্রতিবাদী পক্ষের লেখা। একজন কবিই পারেন পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মেলবন্ধন নির্মাণ করতে। 

কবি কবিতার পথ ধরে হেঁটে চলেন স্বপ্নের দিগন্তে। কবিতার স্নিগ্ধতার সুবাসিত করেন আগামীর পথ চলা। 

‘কতদূর যেতে পারি
কতদূর যাওয়া যায় বেদনাকে ছেড়ে?
যতদূর বাড়িয়েছি পা, ততবার জ্বলেছে আগুন। 
বাতাসে উড়েছে চাঁদ পোড়া ছাই।’

খুব বাস্তব জীবনের কথা। এ প্রশ্ন এই মানবজাতির। আমরা মুখে হাজারো বলি খুব ভালো আছি। কিন্তু সেটি আসলে প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতে। সেই কারণে বোধ হয় কবি শেষ লাইনে লিখছেন- ‘আমি বোধহয় বাউল হলেই ভালো হত।’ 

পাতার পর পাতা এগিয়ে গিয়ে চোখ আটকে যায় ‘জানালায় গোলাপি মায়া’ নামক একটি কবিতায়। কি সুন্দরভাবে ভাষা চয়ন করেছেন। গোলপি মায়া কিংবা বেদনায়-আনন্দে মন খুলে রেখো।আমাদের জীবনের দুঃখগুলো বোধহয় এমনিভাবেই জীবনের সঙ্গে মিলে থাকে। যেমন করে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে হাভাতাদের কথা। তেমনি একটি কবিতার নাম ‘কঙ্কালতন্ত্রে হাড় ভাঙার শব্দ’। সেখানে কবিতা অকপটে বলেছেন মানুষের কথা। ভেজা শহর, নিভে যাওয়া আলোগুলোর দিকে করা তাকিয়ে আছে, কারা যেন ভাত চাই ভাত চাই বলে চিৎকার করছে, কারা যেন এ শহরে নয় যেন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। 

ঠিক পরের কবিতাতে কবি লিখেছেন -

‘এ ডালে, ও ডালে, আড়ালে-আবডালে
উড়েউড়ে, ঘুরেঘুরে সন্তানের মঙ্গল কামনা করে
নিরন্তর একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে চলে।’

যত দারিদ্রতা আসুক নেমে কিন্তু সন্তানের মঙ্গলের জন্য প্রতিটি মানুষ সংগ্রাম করে চলেন। 

টেরাকোটায় আঁকা পৌরাণিক প্রেম বইটির প্রতিটি কবিতায় কবি মাটি ও মননকে চষেছেন নৈবদ্য আবেগে। না হলে এমনি লাইন লেখা যায় না- ‘ঝলমলে এই আলোর শহরে রোজ কতশত স্বপ্ন নিভে যায়।’ কবিতার নাম ‘এ শহরে’। সত্যিই তো গ্রাম থেকে কত স্বপ্ন নিয়ে শহরে পাড়ি দেয় কতশত মানুষ। কিন্তু কতজনকে স্বপ্ন পূরণ হয় তার খোঁজ কার কাছে থাকে। সেই নিভে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে কেবলমাত্র কবিরাই দেখতে পান। সেই কারণে হয়তো শহরের সন্ধ্যার মধ্যে কিছু বদলে যায়নি। সেইকারণে হয়তো - ‘নীল আকাশের বুকে ছাইরঙা মেঘের ডিবি।’ 

যখন আমাদের মন খারাপ হয়ে তখন গভীর রাত্রি অবধি চোখে ঘুম আসে না। তখন চাঁদের আলোকেও মনে হয় বিষন্ন। যেন সেও কিছু বলতে চায়। কবি লিখছেন ‘গলার কাছে আটকে যায় হা-হুতাশ।’ কিন্তু একটা সময় আসে ঘুম রাত্রি যাপনের জন্য তৈরি হয়। আর লেখা ভগ্নাবশেষ জীবনের যাবতীয় গদ্য-পদ্য। সব শেষে সেই কবিতাটির কথায় আসি। যার নামে পদ্যময় বইটি, যার নামকরণে এই মলাট। 

টেরাকোটায় আঁকা পৌরাণিক প্রেম কবিতার কথায়। প্রতিটি মানুষ তার নিজের জন্য কিছুটা সময় বাঁচিয়ে রাখে। খুব একান্তই নিজের মধ্যে জমাটবদ্ধ চাওয়া পাওয়ার গদ্যগুলো নিয়ে ভাবতে থাকে। তাই ভুলে যায় সে কখন উদাসি বাউল হয়েছে। আসলে সব কিছুর ভিড়ে এক অলৌকিক শক্তি লুকিয়ে থাকে। যাকে প্রেম বলতে পারি। কবি একেবারে কবিতার শেষে এবং শেষ পঙক্তিতে বলছেন- 

‘তুমি শুধু এভাবেই থেকে যাও আমার মনে…’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়