ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পার্কবেঞ্চের কবিতা: মরণ ও প্রেমের সিংহাসন

মাঈন উদ্দিন আহমেদ

প্রকাশিত: ১২:২৯, ২৯ অক্টোবর ২০২২  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

‘জীবনের ঔরষে জন্ম নেয় মরণের অপরূপ রং-লীলা-সাজ
মতিনের মৃত দুহিতার দিকে চেয়ে এ খবর পেয়েছি আজ!’
চরণ দুটি এ সময়ের আলোচিত কবি সৌম্য সালেকের ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের ‘একটি বিষম গান’ কবিতার অংশবিশেষ। কবির গাঢ় জীবনবোধের নমুনা, জন্ম-মৃত্যু ভাবনার স্বরূপ দুটি লাইনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ কবি সৌম্য সালেকের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। চল্লিশটি কবিতা নিয়ে সাজানো বইটিতে কবির ভাবনার জগৎ ও জননী, জীবন ও যাপন, মোহ ও মৃত্যু, প্রেম ও কামনার উপলব্ধির চমৎকার নান্দনিক নমুনা পাওয়া যায়।

জন্ম যেমন সুন্দর সত্য, তেমন মৃত্যুও। মৃত্যুকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তা আমরা সবাই জানি। তবুও যখন হাজির হয় প্রিয়জনের মৃত্যু; তখন মনে হয় বেদনার নির্দয় বন্যায় ভেসে যায় নিজের জীবন। শত সান্ত্বনার সুরেলা বাক্যেও বেদনা ঘোচে না একটুও। এই বেদনার ঢেউ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে, যখন সন্তান দেখে মায়ের মৃত্যু। বিষয়টি অত্যন্ত দরদ ও ঈর্ষণীয় দক্ষতায় কবি তার ‘মাতৃহারার জন্য’ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন—
‘কেউ তার বেদনা ঘোচাতে পারবে না
না পাহাড়, না স্বজনের সজল-প্রবোধ
না বাতাস, না পাখিদের নীরব-নিশুতি:
যে তার মাকে দেখেছে খাটে, মানুষের কাঁধে—
শ্মশান বা কবরের অভিমুখে...’

আমাদের জীবনের পথ ধরে লেগে থাকে মৃত্যুভয়। জীবন চলে সংশয় নিয়ে। মৃত্যুর অদৃশ্য অপছায়া উপেক্ষার কোনো উপায় জানা নেই কারো। কবি তার ‘মারির মুহূর্তে’ কবিতায় মৃত্যুভয় ও সংশয় বুকে নিয়ে বলেন—
‘মৃত্যুর অপছায়া নাচে আজ দশদিকে
কোথায় যাব, পালাব কোথায়
কখন আসবে শোভা—’

পালিয়ে মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া যায় না এবং মৃত্যু যে আদতে এক আশ্চর্য শিল্প, সে কথা কবি তার ‘কাক ও কেরানি’ কবিতায় স্মরণ করিয়ে দেন—‘অতর্কিত অপঘাতে কাকের মতো পথপার্শ্বে মরে যাবার মাঝেও কিছু শিল্প আছে, শ্রান্ত পথিক তাকে দেখে বিরতি নেয়, বিগলিত হয়!’

জীবন গতিশীল, রোমাঞ্চে ঘেরা ঐশ্বরিক উপহার। মৃত্যু নিয়ে বেশি ভাবলে, জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত গতি যায় থমকে। ফলে নিজস্ব ছন্দের তাল কেটে যায়, হারায় আপন মহিমা। মৃত্যুভয় নিয়ে বুঁদ হয়ে না থাকতে পাঠককে কবি তার ‘কান্না ও মৃত্যু শেষে’ কবিতায় শোনান—‘দিনের পর দিন সে মৃত্যুর ভয়ে এতটাই কেঁদেছে যে, জীবনে বেশিদূর নিয়ে যেতে পারেনি।’

আমাদের জীবন-মরণের ব্যবধানে যতটুকু সময়, তার মধ্যেই ঘটে যায় কত কী! যার বড় অংশজুড়ে থাকে প্রেম ও নিঃসঙ্গতার আত্মীয়তা। চেতন বা অবচেতনে আমরা প্রেমে পড়ে যাই বারবার। এ যেন অপ্রতিরোধ্য উন্মাদনার হাওয়া, হুটহাট হানা দেয় হৃদয়ের উন্মুক্ত আঙিনায়। এই অমোঘ বাস্তবতার কাব্যিক উপস্থাপন পাওয়া যায় কবির ‘প্রেমে পড়ে’ কবিতায়—
‘বারবার প্রেমে পড়ে হয়েছি অস্থির
দুরুদুরু বুকের কাঁপন হালকা ওড়নার মতো ভেসেছে হাওয়ায়
এই ক্ষ্যাপ আর কত দোলাবে চরম—’

প্রেমের অনুভূতির চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো অনুভূতি আছে নাকি আর! প্রেম পরশের প্রশান্তিতে পলকেই বুজে যায় চোখ। হৃদয় হারিয়ে যায় অনন্ত শান্তির উদ্দেশ্য। অনুর্বর ভূমির বুক ভেসে যায় ফুলেল সৌরভে। ‘হাড়ের পেখম’ কবিতায় কবি বলেন—
‘এবং ওরা কাছে এলো
চোখের পর্দা গেল বুজে
দৃষ্টি খোঁজে হৃদয় অতল
বুকে ছোটে তরুণ মৃগপাল।’

কারো কারো জীবনে প্রেম আসে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে। কিছু সোনালি স্মৃতির বিনিময়ে দিয়ে যায় দুঃসহ বাকিটা জীবন। যে এসেছিল প্রেমের নিশান হাতে, তাকে জীবন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা দুঃসাধ্য ব্যাপার। শরীরের আঁকেবাঁকে, অস্থিসন্ধি আর নিউরনের গুহায় সে লেগে থাকে দারুণ দৌরাত্ম্য নিয়ে। দিকটি কবি তার ভাষায় তুলে ধরেছেন ‘অভিজ্ঞান’ কবিতায়—
‘কিছুকাল হলো মুছেছে মনন থেকে লায়লার দীর্ঘশ্বাস
থেমেছে হাওয়ার রথ—সবুজ সংকেত নিভু নিভু!
তবু কিছু প্রেমে, কথা কিছু আছে লোকে লোকে—
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনালোকে অন্দরে-কন্দরে...’

প্রেমের হাত ধরে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় নির্দয় অবহেলা, ঘৃণা। ঘৃণার ঘাঁয়ে হৃদয় হয়ে ওঠে ধূসর। জেগে ওঠে দারুণ আত্ম-বিদ্রোহ। ধ্বংস অথবা নতুনভাবে জ্বলে ওঠার জয়গান। ‘বুনো স্বপ্নের গ্রাফিতি কবিতায় কবি বলেন—‘প্রতিটি ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় একেকটি বারুদের ছেলা, প্রতিপর বঞ্চনার ঘাতে সে জ্বলবেই।’

আবার প্রেমের অপর পাশেই লাল সংকেত দেখায় নিঃসঙ্গতার ভয়াল ঐকতান। চারিপাশে এতলোক তবু যেন কেউ নেই। জন্ম ও মৃত্যুর মতোই স্রেফ একা তখন মানুষ। সেই একাকিত্বের কথা বলতে গিয়ে কবি কাব্যিক বুননে তার ‘প্রেমে পড়ে’ কবিতার শেষে বলেন—
‘নেই লোক, নেই সঙ্গ, নেই প্রাণ—প্রাণের মতন,
তাই একা গানে গানে ফেরি করি প্রেমের কাহন।’

ছন্দ-মাত্রা ও অন্ত্যমিলের কাব্যিক চাতুর্য উপেক্ষা করেও সৌম্য সালেকের ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বইটি পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়