ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

পদ্মা সেতু হয়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় আসছে ঝালকাঠির পেয়ারা

ঝালকাঠি প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ৩০ জুলাই ২০২২  

সংগৃহীত

সংগৃহীত

ট্রাকে পদ্মা সেতু হয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে ঝালকাঠির পেয়ারা। কম সময়ে ঢাকার বাজারে পেয়ারা সরবরাহ করতে পেরে খুশি পাইকাররা। আবার চাষিরাও ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন পেয়ারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝালকাঠি সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও বরিশালের বানারিপাড়া উপজেলার ৫৫ গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে মিষ্টি পেয়ারা রাজ্য। প্রতিবছর আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস এলেই পেয়ারার কারণে পাল্টে যায় এসব অঞ্চলের চিত্র। পেয়ারা বেচাকেনার জন্য ওইসব এলাকার খালে রয়েছে ভাসমান বাজারও। প্রতিদিন কয়েকশ নৌকায় চাষিরা পেয়ারা বিক্রি করতে আসেন। ট্রাক ও বড় বড় ট্রলার নিয়ে আসেন পাইকাররা। আবার পর্যটকরাও কিনে নেন এখানকার পেয়ারা।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ায় আরিচা ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা না থাকায় পাইকার ও পর্যটকদের আগমন প্রতিবছরের চেয়ে এ বছর বেশি। ফলে এ অঞ্চলের শুধু পেয়ারাই নয়, অন্য কৃষি পণ্যও ঢাকাসহ সারাদেশে অল্প সময়ে সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে।

ঝালকাঠির শহর থেকে কীর্তিপাশা হয়ে সরু সড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই বিখ্যাত ভীমরুলী বাজার। খালের পাড় ঘেঁষে বিখ্যাত ভাসমান বাজারে যেতে যেতে চোখ প্রশান্ত করবে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। যদিও এক সময়ের মেঠোপথ এখন পিচঢালা পাকা সড়ক। ঝালকাঠি শহর থেকেই মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, মাহিন্দ্রা ও লেগুনাযোগে মাত্র ৩০ মিনিটেই পৌঁছা যায় ওই বাজারে।

প্রাকৃতিক অপূর্ব দৃশ্য ও ভাসমান বাজার উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরাও। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, বিদেশি পর্যটকরাও আসেন উপভোগ করতে।

স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট সদর উপজেলার ভীমরুলীতে। যা সারা দেশেই অনন্য। এছাড়া পাশের পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) আটঘর, কুড়িয়ানা, আতা, ঝালকাঠির মাদ্রা। এসবই পিরোজপুর সন্ধ্যা নদী থেকে বয়ে আসা একই খাল পাড়ে অবস্থিত। এখানকার আঁকাবাঁকা খালের দুপাড়ে হাজার হাজার একর জমিতে রয়েছে পেয়ারা বাগান।

ভীমরুলী এলাকার পেয়ারা চাষি গৌতম মিস্ত্রি বলেন, ‘আমরা কয়েক পুরুষ পেয়ারা চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করি। প্রতিবছরের চেয়ে এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন আমরাও পেয়ার ন্যায্য দাম পাচ্ছি। আগের পাইকারদের দ্বারে দ্বারে ভালো দামের আশায় ঘুরতে হতো। আর এখন পাইকাররাই আগ্রহী হয়ে আমাদের ডেকে পেয়ারা কিনছেন।’

স্থানীয় পেয়ারা ব্যবসায়ী আবুল বাশার বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে পেয়ারা ব্যবসায় জড়াই। আমার ব্যবসার বয়স অর্ধশত বছর পেরিয়েছে। পাইকারি দরে পেয়ারা কিনে ঢাকা পাঠাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘৬০-৭০ দশকে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো হতো লঞ্চে। আশির দশকে ঝালকাঠি থেকে স্টিমারে তুলে দেওয়া হতো পেয়ারা। নব্বই দশকে বানারীপাড়ার জম্বুদ্বীপ থেকে প্রতিদিন দু-চারটি পিকআপে ঢাকায় পেয়ারা পাঠানো শুরু হয়। পরে ২০১৬ সালে ট্রাক এবং ২০১৯ সাল থেকে বড় ট্রাকের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে ভোগান্তি ছাড়াই পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় পেয়ারা পাঠাচ্ছি।’

এখানকার আড়তদারদের মতে, লঞ্চ-ট্রাক যে পথেই পাঠানো হোক, ঢাকার ভোক্তাদের কাছে পেয়ারা পৌঁছাতো একদিন পর। দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়ায় এ সময়ের মধ্যে পেয়ারার রং-স্বাদ নষ্ট হতো। পেকে পচে যেত অর্ধেক পেয়ারা। এতে চাষিরা ন্যায্যদাম পেতেন না। পদ্মা সেতুর কল্যাণে এখন সকালে গাছ থেকে সংগৃহীত পেয়ারা দুপুরের আগেই পৌঁছে যাচ্ছে ঢাকায়। এতে রং-স্বাদ দুটিই থাকছে অটুট।

পেয়ারা কিনতে ভীমরুলী ভাসমান বাজারে এসেছেন ঢাকার ব্যবসায়ী অপূর্ব মিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি পেয়ারা কিনেছি ১৮-২০ টাকা দরে। খুচরা ক্রেতাদের কাছে ৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারছি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ফলটির বাজারজাত সহজ হওয়ায় কৃষক ও আড়তদার দুপক্ষই লাভবান হচ্ছে। তিন থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে পেয়ারা সরবরাহ করা হচ্ছে।

চাষি সুদেব হালদার জানান, তিনি ৫০ একর জমিতে পেয়ারা বাগান করেছেন। ফলনের পুরোটাই ঢাকায় পাঠাবেন। ২০ টাকা কেজি দর পেলেই তিনি খুশি।

প্রবীণ চাষি বঙ্কিম চন্দ্র মন্ডল জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে ব্রাহ্মণকাঠি গ্রামের কালীচরণ মজুমদার প্রথম এ অঞ্চলে পেয়ারার আবাদ করেন। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে তা ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা, গাভারামচন্দ্রপুর, নবগ্রাম, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায় এখন কয়েক হাজার একর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়।

ঝালকাঠি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুলতানা আফরোজ বলেন, উপজেলার ১২০ হেক্টর জমিতে পেয়ারা বাগান রয়েছে। এ বছর প্রতি হেক্টরে ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ টন। চাষিরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কারণে সরাসরি ঢাকায় পেয়ারা যাওয়ায় এবার দাম বেশি পাচ্ছেন। এ বছর ১৫ থেকে ২০ দিন দেরিতে ফলন ধরায় পেয়ারার ভরা মৌসুম এখন চলছে।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, পদ্মা সেতুর প্রভাবে ঝালকাঠিতে কৃষি বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটবে। কৃষক ও কৃষির উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এর ফলে দ্রুত কৃষকের উৎপাদিত পণ্য দেশের সব বাজারে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ফেরির অপেক্ষায় কৃষি পণ্য নষ্ট ও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। কৃষকের নগদ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হচ্ছে। বাকিতে পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে না। বিশেষ করে সবজি, আমড়া ও পেয়ারার বাজার তরান্বিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, ঝালকাঠির ব্রান্ড পণ্য পেয়ারা ও শীতলপাটি এতদিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কারণ বিশ্বের সব পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে পেয়ারা রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। সরাসরি ন্যায্যমূল্যে বেশি করে কিনে নিতে পারবে শীতলপাটি।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়