ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

নৈসর্গিক এক জনপদের নাম নেত্রকোনা

শীর্ষ খবর ডটকম

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ১৪ অক্টোবর ২০২০  

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এ অঞ্চল গুপ্ত সম্রাটগণের অধীন ছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মুসলিম রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। পরে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮০ খিস্টাব্দে হওয়া নেত্রকোনা মহকুমাকে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলা করা হয়। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক নেত্রকোনার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

গারো পাহাড়

গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য ও বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সুসং দুর্গাপুর এর উত্তর সিমান্তে নলুয়াপাড়া, ফারংপাড়া, বাড়মারি, ডাহাপাড়া, ভবানিপুর , বিজয়পুর ও রানিখং সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এর বিস্তার। এই পাহাড়ে প্রচুর পরিমানে মুল্যবান শাল গাছ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। এই পাহাড় গুলো প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্যের আধার।

সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি

এক সময় দুর্গাপুর ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। ৩ হাজার ৩শ’ ৫৯ বর্গমাইল এলাকা ও প্রায় সাড়ে ৯শ’ গ্রাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুসং রাজ্যের রাজধানী ছিল দুর্গাপুর। বর্তমানে এটি নেত্রকোনার একটি উপজেলা। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে তার পরবর্তী বংশধররা প্রায় ৬৬৭ বছর শাসন করেন এ রাজ্য। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামে এক রাজার শাসনামল থেকে সুসং রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাজপরিবারে বিরোধের সূত্রপাত হয়। ফলে এক সময় গোটা রাজ্য চারটি হিস্যায় ভাগ হয়ে যায় এবং চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাড়িগুলো ‘বড় বাড়ি’, ‘মধ্যম বাড়ি’, ‘আবু বাড়ি’ (ছোট অর্থে) ও ‘দু’আনি বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ‘৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং পরবর্তীতে ‘৫৪ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাস হবার পর রাজবংশের সদস্যরা ভারতে চলে যান। আর এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটে অনেক শৌর্য-বীর্যখ্যাত সুসং রাজ্যের।

সুসং রাজবাড়ি দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। পরিখাবেষ্টিত রাজবাড়ির অভ্যন্তরে ছিল সৈনিকদের আবাস, বিচারালয়, কারাগৃহ, অস্ত্রাগার, চিড়িয়াখানা, হাতিশালা, রাজপরিবারের সদস্যদের প্রাসাদ, শয়নকক্ষ, কাছারি, বৈঠকখানা ইত্যাদি। ১৩০৪ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সুসং রাজ্যের রাজা জগতকৃষ্ণ সিংহ প্রাচীর চাপা পড়ে নিহত হন এবং রাজবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বর্তমানে যে নিদর্শনগুলো টিকে আছে তার অধিকাংশই জগতকৃষ্ণের পরবর্তী বংশধরদের নির্মিত।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি

দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ড এর পাশেই অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে। সুসং দুর্গাপুর ও এর আশপাশের উপজেলা কলমাকান্দা, পূর্বধলা, হালুয়াঘাট এবং ধোবাউড়ায় রয়েছে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাই প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এদের জীবনধারা যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি বৈচিত্র্যময় এদের সংস্কৃতিও। তাদের এসব ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং চর্চার জন্যই ১৯৭৭ সালে সুসং দুর্গাপুরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর সময়কালে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এখানে প্রায় সারা বছরই নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ

১৯৪৬-৫০ সালে তখনকার জমিদার বাড়ির ভাগ্নে কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে জমিদারদেরই বিরুদ্ধে শুরু হয় টঙ্ক আন্দোলন। টংক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছ দূর গেলে এম.কে.সি.এম হাই স্কুলের পাশে গেলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। মরহুম রাজনীতিবিদ জালাল উদ্দিন তালুকদারের দানকৃত জমিতে এ স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণিসিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী মণিসিংহ মেলা নামে লোকজ মেলা বসে।

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী

সুসং দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় যেতে হয় রানিখং গ্রামে। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। রানিখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে।

হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ

দুর্গাপুর বাজার থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাওয়ার পথে কামারখালী বাজারের পাশে বহেরাতলীতে অবস্থিত রাশিমণি এই স্মৃতিসৌধ। সীমান্তবর্তী, গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বগাঝরা’ নামক গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি। রাশিমণি সেই গ্রামেরই একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। ব্রিটিশ মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। টংক আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন। টংক মানে ধান কড়ারি খাজনা।

সাদা মাটির পাহাড়

দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের শসার পাড় এবং বহেরাতলী গ্রামে সাদা মাটি অবস্থিত। এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধার গুলো দেখতে অত্যন্ত চমৎকার।

সোমেশ্বরী নদী

সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় প্রাবাহিত একটি নদীর নাম। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। । ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্র অঞ্চলকে বাইশা গারো নামের এক অত্যাচারী গারো শাসক এর হাত থেকে মুক্ত করে নেয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

কংশ নদী

কংশ নদী ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগের তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এই নদীটির উৎপত্তি। উৎস থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলা সদরের প্রায় ১৬ কি.মি. উত্তর দিয়ে কংস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীতে মিশেছে। কংস ও সোমেশ্বরী মিলিত স্রোত বাউলাই নদী নামে পরিচিত। প্রবাহ পথে নদীটি ফুলপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, পূর্বধলা, র্দুর্গাপুর, নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

যেভাবে যাবেন–ঢাকা থেকে নেত্রকোনার দূরত্ব প্রায় ১৬২ কিঃ মিঃ। খালিয়াজুরি উপজেলা সদর ব্যতীত অন্যান্য সকল উপজেলা সদর থেকে ঢাকার সাথে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু আছে।

রেলপথ প্রায় ১৮৩ কিঃ মিঃ। আগস্ট ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট হতে ‘হাওড় এক্সপ্রেস’ নামে ঢাকা-মোহনগঞ্জ ভায়া নেত্রকোণা রুটে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে। তবে পূর্ব হতেই মোহনগঞ্জ-নেত্রকোণা-ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে মেইল ট্রেন সার্ভিস চালু আছে। এছাড়া প্রতিদিন ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ ভায়া নেত্রকোণা রুটে ২টি লোকাল ট্রেন সার্ভিস চালু আছে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়