দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ নিয়ে সতর্ক করলেন বিশেষজ্ঞরা
হেলথ ডেস্ক
ফাইল ছবি
দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও শনাক্ত আবারও বাড়ছে। মৃত্যুশূন্য অবস্থা থেকে সর্বশেষ দৈনিক মৃত্যু ছয়জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার করোনা শনাক্তের হার ১ দশমিকের নিচ থেকে আবার ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থাকে দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ বিরাজমান বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ঢেউ মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে সরকার করোনা সংক্রমণ রোধে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনীহা দেখা গেছে।
এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণ রোধে ছয়টি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সচিব ও বিভাগীয় কমিশনারদের অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্দেশনার মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মাস্ক পরায়। সবক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা এবং দোকান, শপিংমল, বাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরিধান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও নির্দেশনায় জানানো হয়েছে।
তবে সরকারের কঠোর নির্দেশনার পরও মাঠপর্যায়ে মাস্ক পরায় আগ্রহ কম সাধারণ মানুষের। করোনা নিয়েও কম আগ্রহ দেখা গেছে সাধারণের মধ্যে। রাস্তায়, গণপরিবহন, বাজার কিংবা সাধারণ সভায়ও মাস্ক ছাড়াই সাধারণ মানুষের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে।
দেশ করোনার চতুর্থ ঢেউয়ে প্রবেশ করলেও আগের তিনটি ঢেউয়ের মতো অতটা খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি এখনো। করোনা সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে রোগীর চাপ কম। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিশষজ্ঞরা। কয়েকদিন ধরে দৈনিক মৃত্যু বাড়ছে। শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বমুখী। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, করোনা সংক্রমণ খুব দ্রুতই বাড়ছে। তবে করোনার চতুর্থ ঢেউ বেশিদিন থাকবে না। জুলাই মাসে এই সংক্রমণ কমে যেতে পারে। যে সংক্রমণ যত দ্রুত বাড়ে তা তত দ্রুত কমে যায়।
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নয়াপল্টন, পান্থপথ, বাংলামোটর এলাকায় দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষের মুখেই মাস্ক নেই। বসুন্ধরা শপিংমল ও ইস্টার্ন প্লাজায় মাস্ক ছাড়া প্রবেশ করতে না দেওয়ায় বাধ্য হয়ে পরতে হচ্ছে। মাস্ক ছাড়া বাইরে অবস্থান করলেও এই দুটি শপিংমলে প্রবেশের সময় মাস্ক পরতে বাধ্য হচ্ছেন সবাই। তবে অন্যান্য শপিংমল ও মার্কেটে মাস্ক ছাড়াই ক্রেতা সাধারণকে প্রবেশ করতে দেখা যায়।
কারওয়ান বাজারে বাজার করতে আসেন সাইফুল। তার মুখেও মাস্ক দেখা যায়নি। মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনা এখন তেমন বড় বিষয় নয়। আমি টিকা নিয়েছি, সমস্যা হবে না। মাস্ক পরে বের হতে মনে ছিল না বলেও জানান তিনি।
সেখানে কথা হয় আরেকজন পথচারীর সঙ্গে। তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়েছি, এ কারণে মাস্ক পরতে মনে ছিল না। অভ্যাস না থাকায় ভুলে যাই।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিয়ে মাস্ক পরা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসনকে মাঠ পর্যায়ে কঠোর হতে হবে।
এ বিষয়ে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, এ থেকে বাঁচতে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। অন্যথায় সংক্রমণ আরও বাড়বে। এরই মধ্যে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী সরকার নির্দেশনা দিয়েছে। তবে নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারকে মাস্ক পরিধান বাস্তবায়নে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবাইকে করোনা নিয়ে সচেতন থাকার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শও দেন তিনি।
মাস্ক পরা নিশ্চিতে করণীয় জানতে চাইলে মোশতাক হোসেন বলেন, শুধু নির্দেশনা দিয়ে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা যাবে না। এজন্য সরকারকে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। এজন্য বরাদ্দও রাখতে হবে। প্রয়োজনে যাদের মাস্ক কেনার সামর্থ নেই, তাদের মধ্যে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করতে হবে। শুধু নির্দেশনা দিলেই কাজ হবে না।
তিনি বলেন, অফিস-আদালতে কমিটি করে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মার্কেট বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে কর্মী রেখে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। সিটি করপোরেশনকে পাড়া-মহল্লার দায়িত্ব দিতে হবে।
শুধু অফিস-আদালত নয়, গণপরিবহনে যাত্রী-স্টাফ ও রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরদের মধ্যেও সচেতনতা দেখা যায় না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে তাদের মধ্যে একেবারেই অনাগ্রহ দেখা যায়।
আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও খুব কম মানুষকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়।
রাজধানীর শুক্রাবাদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, হাতেগোনা কয়েকজন শিক্ষার্থী মাস্ক পরে এসেছেন। এক শিক্ষার্থীকে মাস্ক না পরার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মাস্ক পরলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর টিকা নিয়েছি, তাই এখন তেমন ভয় লাগে না।
এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, কিছুদিন করোনা সংক্রমণ কম থাকায় মানুষের মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা কমে গেছে। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে পাড়া-মহল্লায় কাউন্সিলর ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। মসজিদের ইমামের মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। যারা টিকা নেননি তাদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
২০২০ সালের ৩ি১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। আর ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যুর তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চলতি বছরের মার্চের ২৫ তারিখ সরকার সাধারণ ছুটি নাম দিয়ে অফিস-আদালত, যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। টানা ৬৬ দিন চালু থাকে এ ব্যবস্থা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ওই বছরের মার্চে প্রকোপ দেখা দেয় করোনা ‘ডেল্টা ধরন’। এই ধরন নিয়ে দেখা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এই ঢেউ মোকাবিলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। পরে তা ধীরে ধীরে শিথিল করা হয়।
ধীরে ধীরে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর চলতি বছরের শুরুতে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে আসে তৃতীয় ঢেউ। এ অবস্থায় গত ২৮ জানুয়ারি দেশে করোনা শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশে দাঁড়ায়। দেশে করোনা আসার পর থেকে এটিই সবচেয়ে বেশি শনাক্তের হার।
তবে তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউনের পথে হাটেনি সরকার। এ পর্যায়ে অর্ধেক জনবল নিয়ে অফিস করার নির্দেশনার পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশনের ওপর জোর দেয় সরকার। সরকারের এই পদক্ষেপে সফলতাও আসে। প্রথম দুই ঢেউয়ের তুলনায় অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণ। হাসপাতালগুলোতেও করোনা রোগীর ভিড় ছিল অনেকটা কম।
টিকা কার্যক্রমে গতিশীলতা ও সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপে দ্রুত তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে। চলতি বছরের ১১ মার্চ দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
- দেশে করোনায় ১ জনের মৃত্যু, শনাক্তের হার ০.৪৫ শতাংশ
- দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় কারো মৃত্যু হয়নি, শনাক্তের হার ০.২৯ শতাংশ
- দেশে করোনায় একজনের মৃত্যু, শনাক্তের হার ৫.৪৯ শতাংশ
- দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ করোনা টিকার আওতায়
- প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ভিটামিন ‘সি’ খাওয়ার অপকারিতা
- এই ৩ মাছে মারাত্মক ঝুঁকি, ভুলেও নেবেন না পাতে
- দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ২২৩১ জন
- দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৭ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১৪০ জন
- ওমিক্রন মোকাবিলায় সহায়ক যেসব খাবার
- দেশে ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ১ জনের মৃত্যু, শনাক্ত আরও ৮৭৩ জন