ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও করণীয়

হেলথ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১৬ নভেম্বর ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা গত দুই দশক জুড়ে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মারণাত্মক কীটপতঙ্গজনিত মানব রোগে পরিণত হয়েছে এই ডেঙ্গু, যা সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশেও ডেঙ্গু প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত কয়েকদিনে দেশে বেড়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর ঘটনা। তাই অনতিবিলম্বে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া আবশ্যক।

ডেঙ্গু কী

ডেঙ্গু হলো এডিস গোত্রের স্ত্রী মশাবাহিত এক ধরনের ভাইরাস, যা ডেঙ্গি নামে পরিচিত। ভাইরাসটিতে সংক্রমিত মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু জীবাণু মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। কোনো আক্রান্ত মানুষ থেকে আরেক মানুষে এই রোগ ছড়ায় না। তবে সংক্রমিত মানুষটিকে কামড়ানোর ফলে আক্রান্ত মশা অন্য মানুষকে কামড়ালে তখন সেই মানুষটি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গি ভাইরাসে সংক্রমণের ফলে ডেঙ্গু জ্বর হয়। সংক্রমিত মশার সংস্পর্শে আসা সব বয়সের মানুষই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও উপকান্ত্রিয় অঞ্চল বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার শহুর এবং মফস্বল শহরগুলোতে বেশি দেখা যায়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায় ডেঙ্গু জ্বরে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো হলো- হঠাৎ প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, পেশি ও অস্থিসন্ধিতে গুরুতর ব্যথা, ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা (যা জ্বর শুরু হওয়ার ২ থেকে ৫ দিন পরে দেখা দেয়) এবং হালকা রক্তপাত (যেমন নাক ও মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া)।

এই লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৪ থেকে ৬ দিন পরে শুরু হয় এবং ১০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কখনও কখনও লক্ষণগুলো এতটাই হালকা হয় যে ফ্লু বা অন্য কোনও ভাইরাল সংক্রমণের মত মনে হতে পারে।

ডেঙ্গুর গুরুতর মাত্রাগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর, রক্তনালীগুলোর ক্ষতি, নাক এবং মাড়ি থেকে অধিক রক্তপাত, লিভার এবং সংবহনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া। এই লক্ষণগুলো এতটাই ভয়াবহ যে তা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। এই অবস্থাকে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (ডিএসএস) বলা হয়।

যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল এবং সেইসঙ্গে যাদের দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে, তাদের ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ের প্রক্রিয়া

২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার ডেঙ্গু চিকিৎসার খরচ কমানোর প্রয়াসে সারাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার পূর্বে এবং চিকিৎসা সময়কালীন প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য হার নির্ধারণ করে।

জ্বরের তিন দিনের মধ্যে ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্টের সর্বোচ্চ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। পরবর্তী পর্যায়ে ডেঙ্গু নির্ণয় করার জন্য অন্য দুটি পরীক্ষা - আইজিজি এবং আইজিএম-এর ফি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত মূল্য সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা।

ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা

ডেঙ্গু সংক্রমণের চিকিৎসার জন্য আসলে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য এর লক্ষণগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে সাহায্য করার জন্য সাধারণত চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পানি পান ও স্বাস্থ্যকর পানীয় খাবার খাওয়া, প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম নেয়া। তাৎক্ষণিক ব্যথা উপশমের জন্য ডাক্তাররা টাইলেনল বা প্যারাসিটামল প্রেসক্রাইব করে থাকেন, যা অনেক সময় জ্বর কমাতেও সাহায্য করে।

অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ননস্টেরয়ডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধগুলো উপযুক্ত নয়, কারণ এতে অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া প্রতিকার

ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এগুলোর ওপর চূড়ান্তভাবে নির্ভর করা উচিত নয়। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উচিত অবিলম্বে ডেঙ্গু টেস্ট করানো এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।

গিলয় জুস

গিলয় আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এক প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ, সংস্কৃত ভাষায় যার নাম অমৃত; অর্থ অমরত্বের শিকড়। গিলয়ের শিকড় গুঁড়ো করে বা স্যুপে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিকারে গিলয় জ্যুসের বেশ খ্যাতি আছে। এটি বিপাকে সাহায্য করে এবং অনাক্রম্যতা তৈরি করে।

শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ডেঙ্গু জ্বর থেকে আরোগ্য লাভের প্রথম শর্ত। এই জ্যুস প্লেটলেটের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে এবং রোগীকে স্বস্তি দেয়। এক গ্লাস পানিতে গিলয় গাছের দুটি ছোট কান্ড সিদ্ধ করে তা খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া এক কাপ ফুটানো পানিতে কয়েক ফোটা গিলয়ের রস যোগ করে দিনে ২বার পান করা যেতে পারে। তবে গিলয় রস বেশি খাওয়া ঠিক নয়।

পেঁপে পাতার জুস

যেহেতু ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে প্লেটলেটের পরিমাণ কমে যায়, তাই এই সমস্যা সমাধানে পেঁপে পাতার জুস একটি দুর্দান্ত প্রতিকার। এই জুস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরের সময় কিছু পেঁপে পাতা পিষে রস বের করে দিনে ২বার অল্প পরিমাণে পান করা যেতে পারে।

পেয়ারার জুস

পেয়ারার জুস প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এক কাপ পেয়ারার রস দিনে ২বার পান করা যেতে পারে। এছাড়া জুসের বদলে তাজা পেয়ারাতেও ভালো প্রতিকার পাওয়া যায়।

মেথি বীজ

এক কাপ গরম পানিতে কিছু মেথির বীজ ভিজিয়ে রেখে তা ঠান্ডা করতে হবে। অতঃপর এই পানীয় দিনে ২বার করে পান করলে জ্বর কমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপকার পাওয়া যাবে। ভিটামিন সি, কে এবং ফাইবার সমৃদ্ধ মেথির পানি অনেক স্বাস্থ্যগুণ সম্পন্ন।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী খাবার

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকলে ডেঙ্গুর থেকে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। দেহকে রোগ প্রতিরোধক্ষম রাখার জন্য প্রতিদিনের খাদ্যাভাসে লেবু, কমলা, জাম্বুরার মত সাইট্রাস জাতীয় ফল, রসুন, বাদাম, এবং হলুদ রাখা যেতে পারে।

বাংলাদেশে কখন ডেঙ্গু জ্বর হয়

বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণের ঝুঁকি সারা বছরব্যাপীই বিদ্যমান থাকে। তবে বর্ষাকাল তথা জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ঝুঁকির মাত্রাটা সবচেয়ে বেশি থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

এই রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো সংক্রামিত মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এর জন্য মশার বংশ বিস্তারের সব রকম পরিবেশ সমূলে ধ্বংস করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো-

- বর্ষার মৌসুমে বাড়ির ভিতরেও মশা নিরোধক ব্যবহার করা

- বাইরে বের হলে লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট এবং পায়ে মুজা পড়ে পুরো শরীর ঢেকে রাখার চেষ্টা করা

- সন্ধ্যার আগে আগেই জানালা ও দরজা লাগিয়ে দেওেয়া। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা।

- মশার বংশবৃদ্ধির সম্ভাব্য সব জায়গাগুলো ধ্বংস করা। সাধারণত পুরানো টায়ার, বাড়ির সানশেড, ক্যান বা ফুলের টবে বৃষ্টির পানি জমে থাকে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা। ঘরের বাইরে পোষা পশু ও পাখির বাসার বিশেষ করে খাবারের পাত্রগুলো নিয়মিত পরিবর্তন করে দেওয়া।

- বাড়িতে কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করা। এ সময় ঘর ও ঘরের আঙিনা থেকে মশা নির্মুলের দিকে অধিক নজর দিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ব্যাপারে বিশদ জ্ঞানার্জন ডেঙ্গু প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়