ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জুলিয়েটের ঝুল বারান্দা

শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:০৮, ৩১ মে ২০২২  

প্রতীকী

প্রতীকী

কাল্পনিক চরিত্ররাও অনেক সময়ে বাস্তব পৃথিবীর মানুষদের চেয়ে অধিকতর জীবন্ত এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী হয়ে উঠতে পারে। 

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনন্য সৃষ্ট চরিত্র ‘দেবদাস’। ১৯১৭ সালে ‘দেবদাস’ উপন্যাস হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এর পর থেকে যুগে যুগে উপন্যাস বা মুভিতে দেবদাসের অবিমৃষ্যকারিতা, দেবদাস,পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর ত্রিমুখী প্রেম এবং দেবদাসের করুণ মৃত্যুদৃশ্য/বর্ণনা পাঠক বা দর্শকের চোখের কোণে জল ঝরায়নি এমন পাষাণ হৃদয়ের মানুষ আদৌ ছিল বা আছে কিনা সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।

১৯৩৫ সনে প্রম‌থেশ বরুয়া নির্মিত ও অভিনীত দেবদাস থেকে শুরু করে ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাহরুখ খানের ‘দেবদাস’ মুভি শুধুমাত্র বাংলা ভাষাভাষীদের নয়, পুরো উপমহাদেশ এমনকি পৃথিবীময় মানুষজনের নীরব অশ্রুপাতের কারণ হয়েছে।

কেবল দেবদাসই নয়,  পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্যেই বাস্তবের চেয়ে বেশি প্রভাব সৃষ্টিকারী চরিত্র অনেকই আছে। যেমন, সুনীলের ‘সেই সময়’ উপন্যাসের নবীন কুমার, লিও টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা, আরব্য রজনীর আলিবাবা বা সিন্দাবাদ, এডগার রাইজ বারোজের ‘টারজান’, ব্রিটিশ লেখিকা জে. কে. রাউলিং এর হ্যারি পটার, এমনকি কার্টুন ছবি ‘ফ্রোজেন’ এর কুইন এলসা।

২০১০ সালের গ্রীষ্মকাল। সরকারি কাজে জার্মানির মিউনিখ শহরে এসেছিলাম। কাজ শেষে সাতদিনের এক্স বাংলাদেশ লিভ নিয়েছি ইতালির ভেনিস ও রোম  শহরে বেড়াতে যাব বলে। সঙ্গে আমার সেনাবাহিনীর সহকর্মী আকবর। উড়োজাহাজের পরিবর্তে ট্রেনকে পছন্দ করেছি ভ্রমণের বাহন হিসেবে। আমাদের প্রথম গন্তব্য ইতালির বলোনা (Bologna) শহর। সেখানে আকবরের এক চাচাতো বা ফুফাতো ভাই থাকে। সেখানকার নাগরিক। ওর বাসায় যাওয়ার পর তার ও স্ত্রীর আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। সবচেয়ে সুবিধা হলো আমাদের ভ্রমণের ক্ষেত্রে। প্রথমে গেলাম বলোনা যাদুঘরে। এখানে ৫,৩০০ বছর আগের এক বরফ মানুষের (iceman) ফসিল আছে। মিশরের পিরামিডের যেকোনো ফসিলের চেয়ে অবিকৃত এই ফসিল। নাম ওজি (Otji)। তবে আমার আজকের গল্প তাকে নিয়ে নয়। 

আকবরের সেই ভাইয়ের গাড়িতে করে আমরা প্রথমে এসেছি ভেরোনা শহরে। এখান থেকে আমরা ভেনিস হয়ে রোমে যাব। মজার ব্যাপার হলো ভেরোনা শহরের নাম ছেলেবেলা থেকেই আমার পরিচিত। ১৯৭৭ সনে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আমাদের ইংরেজির প্রভাষক ওয়ালিউল্লাহ স্যার দ্রুতপঠন হিসেবে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের Taming of the Shrew নায়কের উপন্যাস রূপ পড়াচ্ছেন। এই পড়ার সময়ে আমরা প্রথম জানতে পারলাম  ইতালিতে রোম ও ভেনিস ছাড়াও ভেরোনা নামের একটি শহর আছে। এই ভেরোনা শহরের এক যুবকই উপন্যাসের ক্যাথারিন নামের সবচেয়ে মুখরা রমণীটিকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিল। শেক্সপীয়ারের ‘Romeo and Juliet‘ এর উপন্যাস রূপও আমি পড়েছি সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই। জগদ্বিখ্যাত এই গল্পের ঘটনাস্থলও ভেরোনা শহর!

১৯৯৯ সালে আমেরিকান চলচ্চিত্রকার জন মেডেন রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনীকে ভিত্তি করে রোমান্টিক কমেডি ড্রামা ‘Shakespear in Love’ মুভি তৈরি করেন। এই মুভি সাতটা একাডেমি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। এই মুভি আমার কাছে ছেলেবেলার ফেলে আসা অতীতকে পুনঃপরিভ্রমণ (revisit)।

মুভির প্রধান চরিত্র উইলস বা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। সে একজন যুবক বয়সী উঠতি কবি, নাট্যকার ও  অভিনেতা। ভালবাসার জীবন বিশীর্ণ হয়ে পড়লে তার অন্তর্গত সৃষ্টিশীলতার অভাব ঘটে। নতুন নাটক লিখতে ব্যর্থ হয় সে বারংবার। এই সময়ে তার নাটকে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ভিওলা (Viola) নামের এক অভিজাত বংশের যুবতী পুরুষের পোষাকে অডিশন দিতে আসে উইলস এর কাছে। সে সময়ে (১৫০৩ সাল) ইংল্যান্ডে আমাদের দেশের মতো ছেলেরাই নাটকে মেয়েদের ভূমিকায় অভিনয় করতো। মেয়েদের অভিনয় করার অনুমতি ছিল না।

ঘটনাক্রমে উইলস এর কাছে ভিওলার আসল পরিচয় উদঘাটিত হয়ে যায় এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এই  ভালোবাসাই উইলস এর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাদম্বিনী দেবীর সান্নিধ্যে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতা দিয়ে তার কবি-জীবন শুরু হওয়ার মতো। নতুনভাবে  সৃষ্টিশীল নাট্যকারে পরিণত উইলস বা উইলিয়াম শেক্সপিয়ার সমস্ত নান্দনিকতা দিয়ে সৃষ্টি করে তার নাটক ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’।

কিন্তু এই যুগলের ভালবাসা সার্থক হওয়ার নয়। এলিজাবেথিয়ান ট্র্যাজেডির অন্তর্দন্দ্ব বা মানসিক টানাপোড়ন সৃষ্ট ট্র্যাজিক পরিণতির কারণে। ভিওলা এক অনুদার রাজপুত্র লর্ড ওয়েসেক্স এর বাগদত্তা। সুতরাং নাটকের প্রদর্শনী শেষে মহারানী ভিওলার অভিনয়ে মুগ্ধ হলেও পুরুষের বেশে অভিনয় করার জন্যে শাস্তি হিসেবে লর্ড ওয়েসেক্স এর সঙ্গে ভিওলার বিবাহ অনুমোদন করেন। নির্ধারিত হয় যে, বিয়ের পরই  নববিবাহিত দম্পতি জাহাজে করে আমেরিকায় তাদের তামাক চাষের ক্ষেত্রে চলে যাবেন। উইলসের সঙ্গে ভিওলার আর কখনই দেখা হবে না। তবে ভিওলার ভালবাসা এরই মধ্যেই উইলসের অন্তর্গত সৃষ্টিশীলতাকে বিকশিত করেছে। তার কলম ছুটে চলে নতুন সৃষ্টির প্রবাহ নিয়ে। ভিওলা চলে যাওয়ার পর ভিওলার প্রতি ভালবাসার অর্ঘ দিয়ে উইলস সৃষ্টি করে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাস্টারপিস ‘The Twelfth Night’।

শেক্সপিয়ার ইন লাভ মুভির শেষ দৃশ্যে  উইলস/ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখতে লিখতে ভাবছেন, “My story starts at sea, a perilous voyage to an unknown land. A shipwreck. The wild waters roar and heave. The brave vessel is dashed all to pieces. And all the helpless souls within her drowned. All save one. A lady. Whose soul is greater than the ocean, and her spirit stronger than the sea's embrace. Not for her a watery end, but a new life beginning on a stranger shore. It will be a love story. For she will be my heroine for all time. And her name will be Viola.”। মুভির শেষ  দৃশ্যপটে ভাসে সাগরে  ডুবে যাওয়া এক জাহাজ থেকে সাঁতরে আসা এক যুবতী। সে উঠছে এক নিবিড় সমুদ্র সৈকতে। এটাই  শেক্সপিয়ারের লেখা  ‘TWELFTH NIGHT’ নাটকের প্রেক্ষাপট!

মুভির আর একটা দৃশ্য আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। সেটা হলো ভেরোনা শহরে জুলিয়েটের বাড়ির ব্যালকনি বা ঝুলবারান্দা, যেখানে উইলস ও  ভিওলা পরস্পরকে ভালবাসা নিবেদন করে। ইতালিতে আসার  পর  যখন শুনলাম ভেরোনাতে জুলিয়েটের বাড়ি আছে, তখন আমার সেই ঝুলবারান্দা দেখার প্রবল লোভে পেয়ে বসল আমাকে।

জুলিয়েটের বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই আপনার চোখে পড়বে দুই পাশের দেয়ালের গায়ে বিকীর্ণ অসংখ্য হস্তলিখিত ভালোবাসার নোট। এগুলোর ভেতর দিয়ে পেছনের দেয়ালকে দেখাই যায় না। পর্যটকদের বিশ্বাস এই দেয়ালের গায়ে যদি তারা কোন ভালবাসার প্রতিজ্ঞার কথা লেখে তবে তা কোনদিনই ভঙ্গ হবে না।

ভেতরে ঢুকতেই উঠানের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্রোঞ্জের তৈরি জুলিয়েটের সোনালি রঙের মূর্তি। সবাই এর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। স্পর্শ করে দেখছে! জুলিয়েটের মূর্তির বামদিকে মাথার ওপরে সেই বিখ্যাত ঝুল বারান্দা যেখানে দাঁড়িয়ে রোমিও জুলিয়েটকে তার অন্তহীন ভালবাসার কথা বলেছিল!

জানা গেল, জুলিয়েটের বাড়িটি ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে  ‘দাল ক্যাপেলো’ নামক এক পরিবারের মালিকানায়। ভেরোনা শহর কর্তৃপক্ষ ১৯০৫ সালে এই পরিবার থেকে বাড়িটি কিনে নেয়। মজার ব্যাপার হলো বিখ্যাত ব্যালকনি বা ঝুলবারান্দাটি বিংশ শতাব্দীর পূর্বে এতে যোগ করা হয়নি! কিন্তু এতে কার কি আসে যায়? কাল্পনিক রোমিও ও জুলিয়েট সেই কবে থেকে সত্যের চেয়েও বেশি ভালবাসার আলো বিকিরণ করে যাচ্ছে সারা জগৎময়।
“When he shall die,
Take him and cut him out in little stars,
And he will make the face of heaven so fine
That all the world will be in love with night
And pay no worship to the garish sun.” -
 William Shakespeare, Romeo and Juliet.

সর্বশেষ
জনপ্রিয়