ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প: সোনার পাথরবাটি (১ম পর্ব)

দীলতাজ রহমান

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ২৩ অক্টোবর ২০২২  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

ধুম বৃষ্টি-বাদল বা খুব গরম পড়েছে তেমন নয়। খুব স্বাভাবিক একটি রাত। তবু নেবুলার ঘুম ভেঙে গেল। এরকম ঘুম তার প্রায়ই ভাঙে। কোনোকালেই তার ঘুম অত গাঢ় নয়। কিন্তু সে রাতে ঘুম ভেঙে তার খুব ছটফট লাগছিল। এর নামই কি তবে উদাস লাগা! সন্ন্যাসরোগ কি এরই নাম! যা তার কখনোই লাগে না।

প্রতি রাতেই বেশ ক’বার করে তার ঘুম ভাঙে। পানি খায়। বাথরুমে যায়। ঘুম আসুক না আসুক আবার শুয়ে পড়ে। বা টিভি দেখতে দেখতে অথবা বই পড়তে পড়তে তার কত রাত পার হয়ে গেছে। আর সে জন্য যে সারাদিন তাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে, নেবুলার ধাতটা তেমনও নয়। সংসারে সবার প্রতি কর্তব্য পালনে নেবুলা অতন্দ্র প্রহরীরর মতো। নিজেরটুকু করে তো করেই, যে দায় তার নয়, তাও সে করে! কিন্তু নেবুলা সে রাতে বুঝতে পারছিল না সে কি করবে! সে কি বাড়িময় হাঁটাহাঁটি করবে, না কি টিভি ছেড়ে দেখতে বসবে! ছাদে যেতে মন চাইছে। কিন্তু পরে যদি লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। তাই সে ইচ্চের লাগামটি টেনে ধরে!

এক ঘুমে রাত পার হয়, এরকম ঘুম সে বহুদিন ঘুমায় না!
পাশের ফ্ল্যাটে তারই মতো পয়তাল্লিশ পেরোনো মহিলার সাথে, যতবার দরজা খোলার পর দেখা হয়ে যায়, ততোবারই সে পানের লাল রসে ভেজা ঠোঁটে বলে ওঠে, ‘ওমা, আইজও আপনি এল্লাহ? এত এল্লাহ এল্লাহ মানু থাহে কেমনতারা?’ মহিলার কথায় নেবুলা মনে মনে চটে ওঠে। মুখে বিরক্তির ভাব প্রকট হয়ে উঠতেই তাড়াতাড়ি ঠাস্ করে দরজা বন্ধ করে দেয়!
কিন্তু নিজের সংসার ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকা সাদাসিধে স্বভাবের, নাতিপুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকা ওই মহিলার কথা মাঝরাতে তার কানে প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। নিজেকে নিয়ে সে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। নেবুলা খুব ভাল করেই জানে একাকীত্ব থেকে মানুষের নানান রোগ হয়। মানুষ আত্মহত্যাও করে এবং সে সংখ্যার একটা অংশ পুরুষও।
নেবুলা গুম হয়ে বিছানায় বসে থাকে। চেনা, পরিচিত থেকে দূরের ভুলে যাওয়া মুখ থেকেও মনে করতে চেষ্টা করে,  কার সাথে সম্পর্কে জড়ানো যায়, যে তার বাকি শূন্য জীবনটি কাছাকাছি থেকে ভরিয়ে তুলতে পারে!
সম্পর্কে জড়ানো মানে বিয়ে। নেবুলা যে দুএকটি প্রেম বা পরকীয়া করেনি তা নয়। কিন্তু ও দেখেছে, কিছুদিন ঘনঘন ফোন বা দেখা করার বিষয়টি থাকলেও পরে তা আর থাকে না। যদিও সে সম্পর্ক সম্পর্কের জায়গায়ই ঠিকই থাকে। কিন্তু তা প্রাণহীন হয়ে থেকে যায়! নেবুলার এখন দরকার জলজ্যান্ত একজন মানুষের প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব! খণ্ডখণ্ডভাবে প্রহরগুলো শূন্য মনে হলেও নিজের জীবনটাকে নেবুলার কখনোই একটানা অর্থহীন মনে হয় না। যেন বেঁচে থাকতেই তার ভালো লাগে। তা যে কোনো অবস্থাতেই!
 নেবুলা মনে মনে ভাবে, কালই পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেবে! তার প্রভুর মতো স্বামীর দরকার নেই। সহযাত্রীর মতো তার একজন বৈধ প্রেমিকের দরকার! কারণ তার তো কারো কাছে ভাত-কাপড়, আশ্রয়, পরিচয় কিছুরই দরকার নেই। বরং বিত্তহীন হলেও সেরকম শিক্ষিতি, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে পেলে সে নিজেই তাকে পালতে পারবে!

নেবুলা ভেবেছিল, সেরকম মানুষের বুঝি অভাব নেই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেয়ার পর জোয়ারের মতো মেসেজ এসে ফোনের স্ত্রিণ ভরে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপণে লেখাই ছিল, মেসেজে তথ্য দিতে হবে। তাই মেসেজের মাধ্যমেই নেবুলা তথ্য আদান-প্রদান করে। অনেকদিন পার হওয়ার পর একদিন ফোনটা বারবার বেজে ওঠে। কিন্তু নেবুলা তখনো পর্যন্ত অচেনা কোনো নাম্বার থেকে আসা ফোন ধরে না! ক্ষেপার পরশ পাথর খোঁজার মতো যোগ্য লোকটিকেও হয়ত নেবুলা অযোগ্য ভেবে ভুল করেছে। অথবা তাকে পেলে যার বর্তে যাওয়ার কথা ছিল, সেও হয়ত নেবুলাকে চিনে নিতে পারেনি!

নেবুলা কোনো বিষয় বাছ-বিচারেই অত দক্ষ নয়। তবে দু’জন মানুষের মুখোমুখি সে হয়েছিল এই বিজ্ঞাপণের বদৌলতে।
পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই নেবুলার নিজের বড় ছেলে শোয়েব কানাডায় লেখাপড়া করে সেখানেই ভাল চাকরি পেয়ে যায় এবং বিয়ে করে সেখানেই সেটেল হয়েছে। তবে বউ বাংলাদেশেরই মেয়ে। শোয়েবের থেকে পাঁচ বছরের ছোট শামীম সপ্তাহখানেক হলো সেও কানাডার অন্য আরেক প্রান্তে লেখাপড়া করতে চলে গেছে। দু’ভাই একত্রে থাকবে এতদিন এই ভেবে আসছিল নেবুলা। কিন্তু নৈকট্য শব্দটি তার জীবন থেকে উবে যাচ্ছে।

দুই ছেলের কেউই মায়ের অত ন্যাওটা নয়। আবার কারো সাথে মন্দ সম্পর্কও নয়! বড় ছেলে কানাডা যাওয়ার পরই ওদের বাবা আচমকা মারা যান। ভদ্রলোক অকালে মারা গেলেও নেবুলার কোনো কষ্ট হয়নি ছোট ছেলেকে মানুষ করতে। চলার মতো টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করা আছে। আছে নিজস্ব ফ্ল্যাটও। সব মিলিয়ে গোছানো একটি সংসার রেখে সরকারের সাবেক আমলা তার স্বামী কিছুটা অকালেই মারা গেছেন।

বড় ছেলে কানাডা যাওয়ার সময় নেবুলা আর ওদের বাবা খুব কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু ছোট ছেলে চলে যেতে তার তার অতো কান্না আসেনি। শুধু মন কিছুটা খারাপ হয়েছে। যোগাযোগ ব্যাবস্থা বৃদ্ধির কারণে পুরো পৃথিবীটাই এখন একটা দেশ মনে হয় নেবুলার!
নেবুলার এখন কারো জন্য কান্না আসে না। বরং নিজের জন্য তার বড় করুণা হয়। সে হিসেব মিলিয়ে দেখে কেউ কোনোদিন তার জন্য একটু দুঃখ করেনি। অনেক কষ্ট করে সে সংসারকে আজকের এই অবস্থায় এনেছে। কখনো কারো বিরুদ্ধে তার কোনো কৈফিয়ত ছিলো না। নেবুলা সৎছেলেরও ভাল মা, বয়সে বেশ ব্যাবধান নিয়েও স্বামীর ভাল স্ত্রী হতে চেয়ে তার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। বয়সে ব্যবধান এবং স্বামীর মৃত্যু স্ত্রী’র অবাধ্য এক সন্তান মানুষ করে তুলতে দীর্ঘ সময় ধরে তার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তবু সে কখনো ক্ষোভ প্রকাশ করেনি!

চলবে...

সর্বশেষ
জনপ্রিয়