ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ছোটগল্প: টোস্ট বিস্কুটের স্ত্রী

সাখাওয়াত হোসেন সজীব

প্রকাশিত: ১৩:১৩, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বিকেল বেলায় দু’কাপ চা নিয়ে রেহানা বেগম বারান্দার টেবিলে রাখলেন, আতিক সাহেব সেখান থেকে এক কাপ চা নিয়ে আবার পেপারে চোখ রাখলেন। রেহানা পড়ে থাকা পত্রিকাটা তুললেন। প্রথম পাতায় লেখা ‘ভালোবাসার গল্প’। কত মানুষের তার প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার নানা রকম ঘটনা। রেহানার জীবনে ভালোবাসা! তা আর হলো কই!

তখনকার সময়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিয়ে। তার ভাগ্যেই পড়ল এক খটখটে জামাই। যে বোধহয় বছরে এক-দুই বারই হাসে। সন্তান হওয়ার পর তো যেন আরও গম্ভীর হয়ে গেল। মনে পড়ে তার বিয়ের সময় রেহানার বান্ধবীরা আতিকের নাম দিয়েছিল ‘টোস্ট বিস্কুট’।

তাদের বিয়ের দিন তার বান্ধবীরা গেট ধরতেই দেখে বর লাজুক দৃষ্টির বদলে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছেন। বরের স্যান্ডেল চুরি করার জন্য রেহানার ছোট্ট ভাইটি খুব চেষ্টা করেছিল। সে-ও নাকি দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর সাহস পায়নি। এমনকি বর-বউয়ের খাওয়ার সময় তার শালিরা যখন দুলাভাইকে খাইয়ে দিতে চেয়েছিল; তখন দুলাভাইয়ের শক্ত জবাব, ‘আমার এইসব ভাল্লাগে না’।
তখন তার এক বান্ধবী বলেছিল, ‘রেহানা! তোর তো সারাজীবন এই টোস্ট বিস্কুটের সাথে কাটাতে হবে রে, তুই শেষ!’

তখন থেকেই আতিকের নাম রেহানার বাপের বাড়িতে ‘টোস্ট বিস্কুট’। সেই টোস্ট বিস্কুটকে নিয়েই আজ বিয়ের ১৫ বছর কাটিয়ে দিচ্ছে।
‘বুঝলা রেহানা...’ আতিক সাহেবের ডাকে তাকালো রেহানা; দেখলো আতিক কেন যেন চিন্তায় আছে।
‘তোমার মনে পড়ে বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার ঢাকা থেকে ভোলা ট্রান্সফার হয়েছিল! দেড় বছর কী কষ্ট করেই না কাটিয়েছি আমরা। তুমিও সেই কষ্টে কী সুন্দর করে চালিয়েছো সংসার।’
হঠাৎ আজ পুরোনো কথা নিয়ে কেন বসলো আতিক। আবার কোনো ঝামেলা হয়নি তো? চিন্তায় রেহানা।
‘আচ্ছা মনে আছে? বিয়ের দু’বছর পর আমায় অফিস থেকে একটা হোন্ডা দিলো। আমরা প্রতি শুক্রবার সেই হোন্ডায় ঢাকা-চক্কর দিতাম। এরপর তো একদিন তোমায় নিয়ে করলাম বাইক অ্যাক্সিডেন্ট। ভাগ্যিস তোমার কিছু হয়নি কিন্তু আমি দুই মাস হাসপাতালে ছিলাম। সেই দুই মাস তুমি কী কষ্টটাই না করে আমার পাশে ছিলে...’
আতিক সাহেবের জন্য রেহানা বেগমের খুব মায়া হলো। একটু গদ্গদ হয়ে বলল, ‘আহা, আমি পাশে না থাকলে কে থাকবে বলো? আমি ছিলাম, আছি, থাকবো।’
‘না, আমি তা ভাবছি না। আমি ভাবছি...’
‘কী ভাবছো?’
‘আমি ভাবছি, আমার এতসব দুর্ভাগ্য তাহলে কি তুমিই টেনে এনেছো!’

রেহানা বেগম রাগান্বিত চোখে তাকালেন। দেখলেন মধ্যবয়স্ক আতিক সাহেব তার ভুড়ি কাঁপিয়ে হো হো করে হাসছেন। অনেকদিন পর সেই হাসি।
হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তুমি না চায়ের সাথে বাকরখানি খেতে পছন্দ কর? বাকরখানি কই?’
রেহানা বেগম রাগেই বললেন, ‘ঘরে বাকরখানি নাই।’
‘আরে, আজ না আমি অফিস থেকেই আসার সময় আনলাম! তুমি বোধহয় খেয়াল করো নাই।’

রেহানা বেগম উঠতে যাবে, তখন আতিক সাহেব তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেই উঠে গেলেন।
আতিক সাহেব ডাইনিং রুমের দিকে যাচ্ছেন আর হেসেই যাচ্ছেন। যদি একবার ফিরে তাকাতেন, দেখতেন তার স্ত্রী মিথ্যা রাগ নিয়ে মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

রেহানা বেগমের মনে হলো, আতিক সাহেবের এই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা তিনি এই পনেরো বছরে সর্বোচ্চ পনেরো দুগুণে ত্রিশবার দেখেছে। হাসলে লোকটাকে কী যে সুন্দর লাগে, সেটি এই জীবনে রেহানা বলতে পারবে কি না সন্দেহ! বলতে না পারলেও তার ব্যাক্তিগত ডায়েরিতে বরাবরের মতো আজকের ডেট দিয়ে লিখে রাখবে, ‘ওহে আমার টোস্ট বিস্কুট, আজকে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলের হাসিটা কিন্তু মনোমুগ্ধকর ছিল। আপনার পরবর্তী হাসি দেখার অপেক্ষায়। ভালোবাসি... ভালোবাসি। ইতি, টোস্ট বিস্কুটের স্ত্রী।’

সর্বশেষ
জনপ্রিয়