ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

গুপ্তচর থেকে রাষ্ট্রনায়ক!

ফিচার ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:১১, ২৩ নভেম্বর ২০২২  

ভ্লাদিমির পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন

দৃঢ় একটি মুখচ্ছবি। হাঁটাচলা অপ্রতিরোধ্য। একে তো শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক। হাবেভাবেও ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ভাবমূর্তি। কখনো খালি গা, সানগ্লাস পরে হেঁটে যাচ্ছেন। কখনও মল্লযুদ্ধে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষকে।

১৯২০ সালের ছবিতেও নাকি দেখা গিয়েছে তাকে! ভ্লাদিমির পুতিন।

কেজিবির এক এজেন্ট থেকে কী করে এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে উঠলেন তিনি? সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু গত শতকের নয়ের দশকে সোভিয়েতের পতনের পরে বরিস ইয়েলৎসিনের প্রশাসনে কূটনীতিক হিসেবে পা রাখেন পুতিন। আর তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকে তার প্রতাপ। ধীরে ধীরে ইয়েলেৎসিনের উত্তরসূরি হিসেবে ক্রমশ উজ্জ্বল হতে থাকে পুতিনের নাম। আসলে ইয়েলেৎসিন শাসক হিসেবে ছিলেন কার্যতই দুর্বল। তার জনপ্রিয়তাও তেমন জোরদার ছিল না। ফলে বিকল্প মুখের উঠে আসা প্রত্যাশিতই ছিল। কেননা এমন কাউকে দরকার ছিল যিনি একটা ভিন্ন ইমেজ গড়ে তুলবেন শক্তি ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার মিশেলে।

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ আব্বাস গালিয়ামভ জানিয়েছেন, ‘রাশিয়ানরা একজন শক্তিশালী নেতার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলার বিষয়টা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল। গোটা দেশের মানসিকতাই ছিল ন্যাটো-বিরোধী।

তার ব্যাখ্যা, এই আবেগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন পুতিন। ক্রমে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তোলেন তিনি। ফলে তার উত্থান কার্যতই অনিবার্য ছিল। ১৯৯৯। ইয়েভগেনি প্রিমাকভ ও সের্গেই স্টেপাশিনের মতো দুই দুর্বল প্রধানমন্ত্রীর পরে সেই স্থানে বসলেন পুতিন। এই সময় থেকেই তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথটা পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে যায়। পরের বছরই ২০০০ সালের মার্চে ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশের মসনদে বসেন পুতিন। শুরু হয় এক নতুন জমানার।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল বুনিয়াদই ছিল মূলত সমাজতন্ত্রের। পুতিন প্রেসিডেন্টে যখন ততদিনে সোভিয়েতের পতনের এক দশক কেটে গিয়েছে। নতুন রুশ প্রেসিডেন্ট সেই সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলেন বটে। কিন্তু উসকে দেন সোভিয়েত আবেগকেও। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে বিকেন্দ্রীকরণের বিপরীত পথে হেঁটে নতুন রাস্তা তৈরি করে ফেলেন তিনি। গ্যালিমভের কথায়, ‘তিনি যতই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছিলেন, ততই তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছিল।’

কেবল দেশে নয়, পশ্চিমেও ক্রমেই জনপ্রিয়তা বাড়ছিল পুতিনের। ২০০৫ সালে মস্কোয় ‘ভিকট্রি ডে’ উদযাপনের সময় চিন, জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স এবং আমেরিকার প্রতিনিধিদের সামনে তিনি বলেন, ‘গোটা বিশ্বে নিরাপত্তা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাই আমাদের সকলের কর্তব্য। পাশাপাশি দেশগুলির মধ্যে এমন সংস্কৃতি তৈরি হোক, যাতে আর কোনও যুদ্ধের প্রয়োজন না পড়ে। সে শীতল হোক কিংবা গরম।’

কিন্তু হাওয়া ক্রমেই ঘুরে যেতে থাকে। ন্যাটো যতই ইউরোপে প্রসারিত হচ্ছিল, তত ছবিটা বদলাচ্ছিল। ২০০৭ সালে আমেরিকাকে কাঠগড়ায় তুলে পুতিন সরাসরি বলেও ফেলেন আমেরিকা নিজেদের জাতীয় সীমানাকে অতিক্রম করে চলেছে। সেই সময় থেকেই ফের যেন ঠান্ডা যুদ্ধের আমেজ ফিরে আসতে শুরু করে।

২০০৮ সালে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যেতে হয় পুতিনকে। কেননা পরপর দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকা যায় না। এই সময়ে তিনি ফের দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। প্রেসিডেন্ট হন দিমিত্রি মেদভেদেভ। প্রথম ৮ বছরের নেতৃত্বে রাশিয়াকে অভিনব অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন পুতিন। এরপর ২০১২ সালে ফের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন পুতিন। ততদিনে প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ চার থেকে ছয় বছর হয়ে গিয়েছে। ২০১৮ সালে আবারো ক্ষমতায় ফেরেন পুতিন। এরপর ২০২০ সালে সংবিধানে এমন পরিবর্তন করে দেন তিনি, যার ফলে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রেসিডেন্ট থাকা নিশ্চিত হয়ে যায়।

কিন্তু কেন? ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার পরেও কেন নতুন করে প্রেসিডেন্টের চেয়ার আঁকড়ে থাকার খেলায় ফিরে আসতে হয়েছিল পুতিনকে? মনে করা হয়, ২০১১ সালে আরবের উত্থান ও লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গদ্দাফির পরিণতি ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল পুতিনের মনে। তার মনে হতে থাকে, এই পরিণতি তারও হবে না তো! ফলে ফের গদির কাছে ফিরে আসাই মনস্থ করেন পুতিন।

 নিয়মিত রুশ খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছে, ‘পুতিনের বদলা’, ‘পুতিনের গোপন লড়াই’ কিংবা ‘১০টি কারণ কেন পুতিন একজন অসাধারণ মানুষ’… এমনই সব শিরোনাম। সারাক্ষণ নিজেকে ভাসিয়ে রাখা। 

অদ্ভুত সব গুজব। পুতিন নাকি ১৯২০ সালেও ছিলেন। নিঃসন্দেহে এই সব গল্পকথা তাকে আরো বেশি করে কুয়াশামাখা মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে তার কারিশমা। সব মিলিয়ে অপ্রতিরোধ্য এক ইমেজ।

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় কী সেই পুতিন ব্র্যান্ডের ক্ষতি হয়েছে? পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, ২০১৪ সালে যখন পুতিন ক্রিমিয়া দখল করলেন, তখন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘ডেভিড’ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ দেড় মাসেও জিততে পারেনি ‘গোলিয়াথ’ রাশিয়া। 

মনে করা হচ্ছে, হয়তো এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া সুবিধা না করতে পারলে এতদিনের ব্র্যান্ড পুতিন ধূলিসাৎ হবেই। তখন হয়তো নতুন কেউ উঠে আসবেন। অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের গল্প লেখা হবে রাশিয়ার জনমানসে। আর যদি তা না হয়? সেক্ষেত্রে আরো নতুন করে মজবুত হতে থাকবে ব্র্যান্ড পুতিন। ঠিক কী ঘটতে চলেছে, তা জানতে আপাতত অবশ্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়