ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কানা রাজার রহস্যময় সুড়ঙ্গ

এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন

প্রকাশিত: ১২:২৬, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় কত যে  রহস্য লুকায়িত আছে তা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ অপার্থিব। অনেক সময় গোলকধাঁধায়  আটকে যেতে হয়, হিসাব মেলা ভার। শুধু পড়লেই হয় না। সেসব রহস্য খুলতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হয় আরো নতুন রহস্যের। এ রকম এক রহস্যময় অথচ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কানা রাজার সুড়ঙ্গ বা আঁধার মানিক । 

যাতে একবার নয়, বার বার ছুটে যেতে মন চায়। তাই পর্যটকেরা কক্সবাজারে এসে অনেকে কানা রাজার গুহার  সন্ধান করে। কক্সবাজারের রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা নামক দুর্গম এলাকায় প্রাচীন ঐতিহ্যের রহস্য চাদরে ঢাকা রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আঁধার মানিক। যা স্থানীয়ভাবে কানা রাজার সুড়ঙ্গ হিসেবে পরিচিত। এই কানা রাজার সুড়ঙ্গকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। হাজার বছরের পুরনো এ সুড়ঙ্গ সংস্কার হলে হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। কক্সবাজার পর্যটন শিল্প বিকাশে উন্নয়নের মেগা প্রকল্পে কানা রাজার গুহা সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়া  হলে অপার সম্ভাবনাময় এ স্থানটি হয়ে উঠবে পর্যটকদের অতি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। 

কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থ ছাড়াও পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত পাকিস্তান পর্যটন ডিপার্টমেন্ট টুরিস্ট গাইড'-এ রামুর কানা রাজার সুড়ঙ্গের কথা লিপিবদ্ধ ছিলো। এই গুহাকে আঁধার মানিক হিসেবেও অনেকে অভিহিত  করেছেন।  ঐতিহাসিক সূত্রমতে এটিকে রাজা চিন পিয়ান বা কিংবেরিং এর উদ্বাস্তু জীবনের শেষ সময়কালের আশ্রয়স্থল বা দুর্গ বলে ধারণা করা হয়। 

কথিত আছে, বর্মী সেনা ও বর্মী অনুগত আরাকানিদের উপর অত্যাচার করার কারণে প্রতিপক্ষের সংঘবদ্ধ আক্রমণে পরাজিত হয়ে চিন পিয়ান বৃহত্তর চট্টগ্রামে পালিয়ে এসে আত্মগোপন করেন। তাকে ধরিয়ে দিতে করতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এ পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য চিন পিয়ান পুনরায় আরাকানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেও বর্মীদের পাল্টা প্রতিরোধের কারণে তিনি রামুর পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেন। এখানে থাকাকালীন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাহাড়ের গভীরে খনন করা হয় এই গোপন সুড়ঙ্গ বা দুর্গ। 

জানা যায়, সেই সময়ের রামুর পূর্বাংশ অনেক ছোট-বড় মগ রাজা-রাজড়ার শাসনাধীন ছিল। রামুর পশ্চিমাংশ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন চুচা বা খাড়িযুক্ত ছিল। বঙ্গোপসাগর থেকে উমখালী হয়ে শিকলঘাটের 'সামরাই' ও রামু মেরংলোয়া সীমান্ত থেকে 'উত্তর মিঠাছড়ির বিল' দূর অতীতের তেমনি ছিল বিশাল বিশাল খাড়ি। রামুর রামকুট ছিল প্রাচীনযুগের আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর ও পোতাশ্রয়। রামু হাসপাতাল এলাকাসংলগ্ন উত্তর মিঠাছড়ি এলাকাতেও নিকট অতীতে যাত্রী- মালামাল বোঝাই ছোটবড় সমুদ্রপোত নোঙর করত। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বার্মা গমনে যাত্রাপথে রামকোট পোতাশ্রয়ে ট্রানজিট কালীন রামুর অপার নৈসর্গিক শোভায় বিমোহিত হয়ে রাজর্ষি উপন্যাসে রামুকে 'রম্যভূমি' বলে অভিহিত করেছিলেন। মনিরঝিল, কাউয়ারখোপ, উখিয়ারঘোনা, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ঈদগড়সহ সন্নিহিত বার্মা সীমান্ত অঞ্চলেও অনেক ছোটবড় মগরাজা- রাজন্যের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। মনিরাজার 'মনিরঝি' (ঝি থেকে ঝিল), ক্যাউ থেকে কাউয়ার খোপ তেমনি উখ্য থেকে উখিয়ার ঘোনা, পোয়াঙ্গের খিল, থোয়াঙ্গারকাটা ইত্যাদি নামকরণেও সেটা অনুমেয় বটে! নানা উত্থান-পতনে বার্মার অনেক পলায়নপর রাজা-শাসকদের আগমন-নির্গমনের ঐতিহাসিক চিহ্নও এখানে বিরল নয়। যেমন অনতিদূরের ঐতিহাসিক শাহ সুজারোড যা চারশো বছরের পুরনো পক্নচিহ্ন। সেই প্রেক্ষিতে আলোচ্য সুড়ঙ্গও তেমন কোন গোপন আশ্রয়স্থল বা কেল্লা হওয়া বিচিত্র নয়। অনুরূপ প্রেক্ষাপটে ৩৬০ পালংখ্যাত উখিয়াতেও একই বা ভিন্ন নামে গুহা বা সুড়ঙ্গ রয়েছে। 

আসলে মানুষের আদিনিবাস ছিলতো গুহাতেই। সভ্যতার আলোর উৎস সেখানেই। তারা যে গুহাবাসেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো এর বড় প্রমাণ তো প্রাচীন ভারতের ইলোরা অজন্তার গুহাচিত্রগুলো। ৫০/৬০ বছর আগেও স্থানীয় অনেকে আলোচ্য আঁধার মানিক গুহায় প্রবেশ করত, যাদের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন বলে শোনা যায়। তারা ঐ গুহায় সোজা দাঁড়িয়ে অনেক ভেতরে প্রবেশ করে কিছু ছোট বড় কক্ষ ও একটি প্রশস্ত হলের মত দেখেছিলেন। আরো ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলে যেতে প্রবেশকারীরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে। বর্তমানে ঐ গুহামুখ পাহাড় ধসে আংশিক বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা এ ঐতিহাসিক সুড়ঙ্গটি ফের উন্মোচন করেছেন রামুর একঝাঁক ছাত্র-যুবক। 

১৯ শতকের গোড়ার দিকে এই গুহা আবিস্কার করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থে এই সুড়ঙ্গ বা আঁধার মানিক সম্পর্কে বিশদ তথ্য রয়েছে। এটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক পাঁচ  কিলোমিটার বলে জানা গেছে। পাহাড়ের উপর দিকে দুটি নিচের দিকে চলে গেছে দুটি সুরঙ্গ। পাহাড় ধ্বংসের কারণে গুহার একটি মুখ আংশিক বন্ধ হয়ে আছে। তাই উক্ত গুহা সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। 

প্রথমে চলে যাবেন কক্সবাজার। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কী কী দেখবেন। সেই তালিকায় রাখুন আঁধার মানিক বা কানা রাজার গুহা দর্শনের। কক্সবাজার থেকে রামু চৌমহনীতে চলে আসুন, মিনিবাস বা অটো রিকশায় করে। কক্সবাজার থেকে মিনিবাসে জন প্রতি ভাড়া পড়বে ৩০ টাকা। আর অটোতে আসলে গুনতে হবে জনপ্রতি ৫০ টাকা। তারপর অটো বা সিএনজি রিজার্ভ নিয়ে চলে আসুন কাউয়ারখোপ উখিয়ার ঘোনার ‘ড্রোমর ঘোনাতে’ সেখানই পেয়ে যাবেন আঁধার মানিক বা কানা রাজার গুহা। রামু চৌমুহনী থেকে সিএনজি নিলে ভাড়া পড়বে আাসা যাওয়ায় ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০  টাকা।কক্সবাজার থেকে সরাসরি সিএনজি নিলে আসা যাওয়ায় ভাড়া পড়বে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। এক অটো বা সি এনজিতে যেতে পারবেন সর্বোচ্চ ৫ জন। কক্সবাজার থেকে কানা রাজার গুহা পর্যন্ত যাতায়াতে সময় লাগবে দেড় থেকে দুই ঘন্টা। দেখতে পাবেন হাজার বছরের স্মৃতি চিহ্ন।যা দেখে আপনি ও অবাক হবেন। সেখানকার আদিবাসীদের মুখে শুনতে পারবেন অনেক রূপকথার গল্প।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়