ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কবিতার যাযাবর: মোহাম্মদ নূরুল হক

শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৪ জুন ২০২২  

সংগৃহীত

সংগৃহীত

মোহাম্মদ নূরুল হক কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক। ব্যক্তিজীবনে তিনি যথেষ্ট আবেগী। তবে কবিতায় আবেগ প্রকাশে সংযমী। তার আবেগ প্রকাশিত হয় ভাষায়, ছন্দে, কবিতায়। ফলে সে আবেগ হয়ে ওঠে যুক্তিসঙ্গত। তাই তো তার আবেগ প্রসঙ্গে কবি ও প্রাবন্ধিক মামুন রশীদ বলেন, ‘মনোযোগী পাঠকমাত্রই তার কবিতায় আবেগের সঙ্গে যুক্তি ও প্রজ্ঞার সমন্বয় খুঁজে পাবেন। কবিতার ক্ষেত্রে কিছু নির্ধারিত শব্দ রয়েছে, যা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি তার আবেগকে স্পষ্ট করে তোলেন। কবিতার জন্য পেলব, গীতল শব্দসমষ্টির প্রতি তার পক্ষপাত স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত, নির্দিষ্ট শব্দমালাকে ঘুরেফিরে কবি নিজেকে প্রকাশের জন্য বেছে নেন।’

এখানে আবেগের প্রসঙ্গ এসেছে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার বই ‘লাল রাত্রির গান’ পড়তে গিয়ে। বলে রাখা ভালো, এটি কবির চতুর্থ কবিতার বই। বইটিতে তেপ্পান্নটি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতার শরীরজুড়ে আবেগ আর বিরহের ছড়াছড়ি। নীরবে-নিভৃতে কবি ভালোবেসে গেছেন। পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন মানব জনম। অথচ কবির কোনো গল্প নেই। যা আছে সব নিজের অনুভূতি। সেই অনুভূতি কারো সঙ্গে ভাগ করেন না তিনি। কারণ তার কোনো বন্ধুও নেই। তাই তো কবি বলেছেন—
‘আমার কোনো বন্ধু নেই
না সচিবালয়ে না পুলিশে—আর্মি—র‌্যাবে
তাই আমার কোনো গল্প থাকে না
এসব আড্ডায়।’ (মানুষের কত গল্প থাকে)
নিভৃতচারী মানুষটি তার দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে রাখেন রাতের গভীরে। আর হেঁটে যান নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। এখানেই তার চিন্তার সার্থকতা।

বলে রাখা ভালো, মোহাম্মদ নূরুল হকের এ পর্যন্ত চারটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে—‘মাতাল নদীর প্রত্ন বিহার’, ‘স্বরচিত চাঁদ’, ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’ ও ‘লাল রাত্রির গান’। এ ছাড়া অগ্রন্থিত অনেক কবিতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইনের পাতায়। তার কবিতায় গ্রামীণ জীবন, নাগরিক জীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি নানাবিধ বিষয় উঠে এসেছে। তার কবিতায় গ্রামবাংলা ধরা দেয় আপন মহিমায়। কারণ তিনি শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও তারুণ্য গ্রামেই কাটিয়েছেন। কর্মের সন্ধানে পা ফেলেছেন নগরে। তাই নগর জীবন তাকে স্মৃতিতাড়িত করে। ফলে নগরীর বাস্তবতা সুনিপুণভাবে তুলেছেন কবিতায়। তিনি বলেন—
‘আমরা গ্রামের ছেলে—চিরকাল অবুঝ-অবুঝ
বুঝিনি স্বার্থের প্যাঁচ, শুধু জানি ভালোবাসাবাসি
আমাদের কোনো ক্যালেন্ডার নেই
কোকিলের ডাক শুনে বুঝে যাই বসন্ত এসেছে
ভুলে যাই কবেকার বিষণ্ন সকাল!
ছন্দে ছন্দে মাঠে নামি
ঘরে ফিরি মাতাল সন্ধ্যায়!’ (কাচারি ঘরের পালা)
গ্রামে বেড়ে ওঠা প্রত্যেকেরই এমন কাচারি ঘরের ইতিহাস বা স্মৃতি রয়েছে। তাই কবিতাটি পড়লে সবাই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বেন বলে মনে করি।

স্মৃতিতাড়িত কবি ভালোবাসারও কাঙাল। তাই তো তার রাত বিরহের। তিনি কেবল ভালোবেসেই যান। তাই তো বিরহকে সঙ্গী করে নেন। ফলে রাত নিয়ে কবির আলাদা দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। রাতের গভীরে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। কবি বলে ওঠেন—
‘অনন্ত তৃষ্ণায় আমি পুড়ি, আর পোড়ে
রাগি রোদ্দুরের চৈত্রে গেরুয়া বাউল;
আমাদের রাত্রি তবু সুর তোলে চির বিরহের!’ (লাল রাত্রির কসম)
কবি আবার অন্যত্র বলে ফেলেন—
‘আয় তবে তন্দ্রাহীন—আয় এই নাদানের বুকের গহিনে
কেমনে মেটাবি তৃষ্ণা আদিগন্ত প্রেমহীন শরাব বিহনে?’ (নিশাচর রাশির জাতক)

মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার পরতে পরতে ইতিহাস, রূপকথা, লোককথা, উপকথা, ঐতিহ্য, প্রণয়োপাখ্যান প্রস্ফূটিত হয়ে উঠেছে। তার ‘আবহমান’ কবিতায় রাধা-কৃষ্ণ, বেহুলা-লখিন্দর, ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনি উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। কবি তাই বলেছেন—
‘রূপকথা-উপকথা লোককথা শুনে
পথ কাটে প্রেমিকের দিন গুনে গুনে।’ (আবহমান)

এই রূপকথা-লোককথার বাইরেও ঘরের সাধারণ নাস্তার টেবিল তার কবিতায় বিশেষায়িত হয়ে ওঠে। নাস্তার টেবিলকে কবিতায় এমনভাবে উপস্থাপন করা কেবল তার দ্বারাই সম্ভব। এমনকি ‘লাল’ রঙের প্রতি কবির বিশেষ অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। তাই তো তার কবিতায়—
১. লাল রাত্রি
২. লাল ষাড়
৩. লাল সূর্য
৪. লাল স্রোত
৫. লাল মাছি
৬. লাল সূর্যাস্ত
৭. লাল হাপর
৮. লাল জবা
ইত্যাদি শব্দযুগল চোখে পড়ে। আবার রাতকে কখনো ‘লাল’ আবার কখনো ‘নীল’ বলেছেন। তার এ শব্দবৈচিত্র্য পাঠককে ভাবাতে চেষ্টা করবে।

কবি যেন বরাবরই একাকিত্ব অনুভব করেন। আর সেই একাকিত্বের অনুষঙ্গ হয়ে বারবার ধরা দেয় রাতের নির্জনতা বা রাতের গভীরতা। তার বেশিরভাগ কবিতায় তাই রাত এসেছে বিভিন্ন প্রসঙ্গে। রাতকে তিনি কখনো গোপনীয়তা, কখনো নিরবতা, কখনো সীমাহীনতা হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাতে কেমন যেন একটা নিঃসঙ্গতা ভর করে আছে। কবি তখন বলে ওঠেন—
‘এই বিকলাঙ্গ রাত আর ওই বিগলিত দিন
আমার নয়, ছিল না কখনো আমার
তবে কেন আমি এই অন্ধকারে একা একা?’ (এই রাত)
আবার তিনি নিঃসঙ্গতাকে ভালোবাসেন না-কি এড়িয়ে চলতে চান, তা ঠিক বোধগম্য নয় আমার কাছে। কেননা কবিই তো বলেছেন—
‘বুঝে ওঠার আগেই দেখি—আমি একা হতে হতে
হয়ে গেছি পৃথিবীর একমাত্র নির্বান্ধব বেকুব জাতক।’ (জুনের জাতক)
এখানে তিনি বছরের জুন মাসকে অভিশপ্ত বলে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ তিনি না-কি জুনের জাতক। এ কথা তার বাবা তাকে বলতেন। তবে রাত, একাকিত্ব ছাড়াও অন্ধকার যেন কবিকে ঘিরে রাখে সব সময়। তাই হয়তো অন্ধকার, আঁধার বা আন্ধার শব্দকে তিনি একাধিক কবিতায় ব্যবহার করছেন। তবে ‘অন্ধকার’ ও ‘আঁধার’ শব্দের চেয়ে ‘আন্ধার’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বহুবার।

এসব দিন-রাত বা বিরহ-বেদনা ছাড়াও কবিকে প্রতিবাদী হতে দেখেছি। কোনো কোনো কবিতায় তিনি প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্ন বিষয়ে। ধর্ষণ, হত্যা, হামলা, জঙ্গিবাদ নিয়েও কথা বলেছেন কবি। তার প্রতিবাদের ধরন এরকম—
‘এদেশে মৃত্যুর উৎসব চলে হরদম,
এদেশে খুনের উৎসব; উপভোগ করে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র
ছিন্নমস্তক যুবক পড়ে থাকে ঘরে-ম্যানহোলে
মন্ত্রীরা উল্লাসে নাচে, হাতে হাতে বিয়ারের গ্লাস।’ (মন্ত্রী মহোদয়গণ)
কেননা রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের অন্যায়-অসঙ্গতিও কবিকে ভাবিত করে। তাই তিনি শ্লেষ বা উষ্মা প্রকাশ করেন কবিতার চরণে চরণে।

মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কার, রূপক, অন্ত্যমিল, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, যমক—সবকিছুই পাঠককে আকৃষ্ট করে। ছন্দের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ফুটে ওঠে প্রতিটি কবিতায়। শুধু কবিতায়ই নয়, একজন বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক হিসেবেও কবিতায় ছন্দের ব্যবহারকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। যারা ছন্দবিরোধী; তাদের তিনি কবি বলতে নারাজ। তবে কখনো কখনো তিনি মুক্তক ছন্দে বা গদ্যছন্দে কবিতা লিখে থাকেন। কেননা কবি মোহাম্মদ নূরুল হকও যথেষ্ট আধুনিক। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে এসে তিনিই বা কেন মধ্যযুগে পড়ে থাকবেন? হাল ফ্যাশনের সবকিছুই তার নজরে পড়ে। এখন ফেসবুক-টুইটারেও তার রাত চমকায়। মোটকথা, পুরাণ থেকে বর্তমান—কোনো কিছুই বাদ যায় না তার কবিতা থেকে। সে কারণেই মোহাম্মদ নূরুল হক সময় সচেতন কবি। পাশাপাশি ছন্দ সচেতন একজন সমালোচকও বটে।

উপমার ক্ষেত্রেও কবি অতুলনীয়। অহেতুক শব্দের ব্যবহার নেই তার কবিতায়। অকল্পনীয় বা অবাস্তব শব্দ বা ভাব তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। যথাযথ উপমার ব্যবহার তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। কবির ভাষায় বলতে গেলে—
‘ডালিম দানার মতো লাল লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দি রাধিকার স্তন। আর—
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।’ (স্রোতের নামতা)
এখানে প্রতিটি শব্দ-উপমা যেন একে অপরের পরিপূরক। কোনোটিকেই বিচ্ছিন্ন করার বা বিচ্ছিন্ন ভাবার আসলে সুযোগ নেই।

সব ছাপিয়ে কবি কখনো কখনো ভালোবাসা-স্নেহ কাতর একজন বাবাও। কেননা কন্যারা বাবার অস্তিত্বজুড়ে বিরাজ করে। তারও প্রমাণ মেলে তার কবিতায়। কবি কন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
‘বাবা তো ক্রন্দনরত পাহাড়ের নাম
গোপন রক্তক্ষরণে
ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে জীবনের আয়ু
অন্তহীন তৃষ্ণা বুকে নিয়ে জেগে থাকে
সাহারা-সাহারা।’ (কন্যাকে লেখা পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম চিঠি)

তাই তো তার কবিতাগুলো পড়া শেষ হলে মনে হয়, বেদনার সুর বেজে ওঠে। বিরহকাতর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। তাই মনে হয়, যাবতীয় দুঃখ, আঁধার, চাঁদ, পাখি, রাত, নদী, জল তার বিরহের উপজীব্য। কবির ভাষায় বলতে গেলে—
‘হয়তো আকাশ ভেঙে পড়ে একফালি রাত কেটে
হয়তো বা কেউ আঘাত পেয়ে যায় ফিরে যায় হেঁটে
কালো কোকিল ডাক দিয়ে যায় বাউল সাথীটিরে।’ (নাগরিক রাতের বয়স)

সবশেষে বলতে হয়, কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতায়ও সফল। তার প্রবন্ধ পড়েও তাকে সফল প্রাবন্ধিক মনে হয়েছে। এবার কবিতা পড়েও তা-ই মনে হলো। কেননা একজন সার্থক কবি হিসেবে সাহিত্যের যে কোনো বিষয়ে সাবলীল ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ রচনায়ও সিদ্ধহস্ত তিনি। আমি তার লেখার বহুল পাঠ, প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। তবে সময়ই হয়তো একদিন কবিকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে। সেই সঙ্গে বাংলা কবিতারও জয় হোক।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়