বিদেশেও কদর বাড়ছে দেশীয় হস্ত ও মৃৎশিল্প পণ্যের

নিউজ ডেস্ক

সবার আগে সব খবর

প্রকাশিত : ০৯:৫৪ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০২২ সোমবার

বিদেশেও কদর বাড়ছে দেশীয় হস্ত ও মৃৎশিল্প পণ্যের

বিদেশেও কদর বাড়ছে দেশীয় হস্ত ও মৃৎশিল্প পণ্যের

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে চলছে দশম জাতীয় এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজ) পণ্য মেলা। গত ২৪ নভেম্বর শুরু হওয়া এ মেলা চলবে আগামী ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের তৈরি দেশীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় এ আয়োজনে প্রতিদিনই বাড়ছে দর্শনার্থীদের ভিড়।

এবার মেলায় বাংলাদেশের হস্ত ও কুটির শিল্পজাত পণ্যের বিশাল সমাহার লক্ষ্য করা গেছে। দেশীয় ক্রেতাদের কাছে এসব পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশে।গতকাল রোববার (২৭ নভেম্বর) সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় সুতার কাব্য নামের একটি স্টলে পাটজাত বাহারি পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে। পাটজাত এসব পণ্য ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। সুতার কাব্য প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রায় একশো কর্মী রয়েছেন। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে এর প্রধান শাখা। ৭০ শতাংশ পণ্যই বিক্রি হয় অনলাইনে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। ২০১৯ সাল থেকে তারা বিদেশে হস্তশিল্পের পণ্য রপ্তানি করছে।সুতার কাব্যের ম্যানেজার হোসাইন মো. ইরশাদ ইবনে শরিফ  বলেন, মেলায় দেশীয় পণ্যের চাহিদা অনেক। ক্রেতাদের অনেক সাড়া পাচ্ছি। তবে আমাদের ৭০ শতাংশ পণ্যই অনলাইনে বিক্রি হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপসহ নানা দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানি হয়।

মেলায় ঘিওর বাঁশ বেত ও শিল্প ক্লাস্টার স্টলে বাঁশের তৈরি চট, মোড়া, হরেক রকমের ঝুড়ি, টুকরি, খাঁচা, চালুন, মাছ-তরকারি ধোয়ার ঝাঁকা, মাছ ধরার চাঁই, আনতা, বেতের তৈরি পাটি ও জায়নামাজ প্রভৃতি পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।

বাঁশ ও বেতের পণ্য তৈরিতে একসময় প্রসিদ্ধ ছিল ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলা মানিকগঞ্জ। কিন্তু দিন দিনই তা কমছে। বাজারে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও স্টিলের তৈরি পণ্যের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ পণ্য। ফলে এসব পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোও আর্থিক অনটনের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। নিজ পেশায় টিকতে না পেরে ভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগর রয়েছেন। পুঁজি স্বল্পতা, বাঁশ ও বেতের উৎপাদন হ্রাস, আর্থিক অসচ্ছলতা এবং উপকরণের অভাবে সেখানে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে ঐহিত্যবাহী এ শিল্প।

তবে এ বছরের এসএমই মেলা উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়তে সরকার বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেছেন, এসএমই পণ্যের বাজারজাতকরণে এসএমই পণ্য মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ মেলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের তৈরি দেশীয় পণ্যের পরিচিতি ও চাহিদা বাড়াবে। এসএমই খাতে পুরুষের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অত্যন্ত প্রশংসনীয় অবদান রাখছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া, গোয়ালডাঙ্গী, জাবরা, তরা (মির্জাপুর), কেল্লাই, উভাজানী এলাকার বংশ পরম্পরায় বাঁশ ও বেত শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারের সদস্যই পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বরটিয় ইউনিয়নের উত্তর শ্রীবাড়ী ঋষিপাড়া গ্রামের ১২০-১৩০টি পরিবার এখনো বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি উন্নতমানের খোল, ধামা, কাঠা, রিং, সেলেন্ডার, ফুটকাপ, টিফিনকির, নৌকা বাসকেট, সেড, পালা দাঁড়ি, টুড়ি, কুলা, ডালা, ঝুড়ি, চালুন, চাটাই মোড়া, খালোই, টুরকি, চেয়ারসহ হরেক রকমের নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করছে। এসব পণ্য জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি হয়। এমনকি এ অঞ্চলের তৈরি এসব কুটির শিল্প সামগ্রী রাজধানী ঢাকা হয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। এসএমই মেলায় এসব পণ্যও প্রদর্শন করা হচ্ছে।

ঘিওর বাঁশ বেত শিল্প ক্লাস্টারের প্রোপ্রাইটর সৌভাগ্য সরকার  বলেন, প্রযুক্তির যুগে বাঁশ ও বেতের পণ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আমরা কাজ করছি। মেলায় বাঁশ ও বেতের নানা পণ্য বিক্রি করছি। সাড়াও ভালো। মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চায়। তবে বেতের দাম এখন অনেক চড়া।

পাট দিয়ে তৈরি হচ্ছে ব্যাগ, শাড়ি, জুতা, স্যান্ডেল, বিছানার চাদর, পর্দা সোফার কভার, কার্পেট এবং আরও নানা ধরনের পণ্য। শতরঞ্জি, পাটের তৈরি টেবিল মেট, পাপোশ এবং তাঁতের তৈরি লেডিস ভেনেটি, ট্রাভেল হ্যান্ড পার্স, মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, আইপ্যাড এবং সব ধরনের অফিস ব্যাগ। এছাড়াও থ্রিপিস, পাঞ্জাবি, শার্ট, নকশি কাথা, বেড শিট, লেডিস এবং জেন্টস ফতুয়া, মেক্সি, পাপোশ ওয়ালমেট পণ্য বিক্রি হচ্ছে। শতভাগ দেশীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় আয়োজন ১০ম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলার দ্বিতীয় দিনে মূলত পাটজাত পণ্য বিক্রির স্টলগুলো নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। এসব স্টলে ক্রেতা সমাগমও বেশি। এসব পণ্য বিক্রি করে অনেক নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে।

এসপি হ্যান্ডিক্রাফটের মালিক সোনিয়া আক্তার পুষ্পা বলেন, পাটের তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ করছি। নকশার কোনো শেষ নেই। ঘর সাজাতে সিকা আছে, টেবিল ম্যাট ও ফ্লোর ম্যাট বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যে দামে এগুলো বিক্রি করি। আমি নয়জন নারীকে চাকরি দিয়েছি। আমরা থার্ড পার্টির মাধ্যমে দেশের বাইরেও পণ্য বিক্রি করছি।

মেলায় মৃৎ শিল্পের বেশ কিছু স্টল দেখা গেছে। মাটির তৈরি করা পাকপাতিল, ঠিলা, কলসি, পুতুল, কুয়ার পাট, খেলনার সামগ্রী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। বিদেশে মাটির তৈরি পামিজ, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গার্ডেন প্রডাক্ট, নাইট লাইট, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম, ফুলদানি, মাটির টব ও মাটির ব্যাংকের চাহিদা আছে। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য যাচ্ছে বিদেশেও।

মেলায় অংশন নেওয়া উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী এবং ৪০ শতাংশ পুরুষ। মেলায় অংশ নিয়েছে ফ্যাশন ডিজাইন খাতের সবচেয়ে বেশি ১৩০টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া খাদ্য/কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্যের ৪৫টি, হস্ত ও কারু শিল্পের ৩৮টি, চামড়াজাত পণ্য খাতের ৩৬টি, পাটজাত পণ্যের ৩৫টি, আইসিটি পণ্যসেবার ৮টি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ৬টি, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স খাতের ৩টি, প্লাস্টিক পণ্যের ৫টি প্রতিষ্ঠান এবার মেলায় অংশ নিয়েছে।

এছাড়া মেলায় আসা দর্শনার্থীদের মাঝে এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচিতি ও কর্মসূচি তুলে ধরার লক্ষ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিতব্য শতভাগ দেশী পণ্যের এ মেলায় উদ্যোক্তাদের জন্য ৩২৫টি প্রতিষ্ঠানের ৩৫১টি স্টলের ব্যবস্থা রয়েছে।